চারদিকে মানুষ গিজগিজ করছে! বিশেষ করে আমাদের মত, এশিয়া বা আফ্রিকার দেশগুলোতে জনসংখ্যা যেন ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে - দু'দিন পরেই হয়তো আর তিল ধারণের ঠাঁই থাকবেনা!
কিন্তু আসলেই কি তাই? নাকি এই হিসেবটা বা বলতে পারেন এই আতঙ্কটা একান্তই অহেতুক?
যদি বলি চোখের সামনে যা দেখছি বা যে ধারণা পাচ্ছি তা পুরোপুরি সত্যি না? অবিশ্বাস্য শোনালেও, এটাই এখনকার বাস্তবতা যে পৃথিবীর জনসংখ্যার গতি এখন উল্টোরথে চলতে শুরু করছে।
চলুন তাহলে, আজকের থিংকের এই ভিডিওতে জেনে নেই - কেন হঠাৎ করে, ১৮ শতকে এসে এভাবে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটা শুরু হয়েছিল? আর এখনই বা কেন , মাত্র তিনশ' বছরের মাথায় এসে জন্সংখ্যা বৃদ্ধির গতি আবার উল্টোদিকে চলতে শুরু করেছে!
এই তো মাত্র ১০ থেকে ১১ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে মানুষের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৪০ লাখের মত - ১৮০০ শতাব্দীতে তা এসে দাঁড়ায় ১০০ কোটিতে। মাত্র ১৩০ বছরে তা ডাবল হয়ে হয় ২০০ কোটি। তার পরে ৫০ বছরেরও কম সময়ে তা আবারও দ্বিগুণ হয়ে যায় ।
১৯৭৫ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৪০০ কোটি। আর এখন? - এখন তো প্রায় ৮ বিলিয়ন বা ৮০০ কোটি ছুঁই ছুঁই করছে।
পৃথিবীতে যে হারে মানুষ বাড়ছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে খাদ্য উৎপাদন বাড়বে না, নিকট ভবিষ্যতে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের কারণে কোটি কোটি মানুষ মারা যাবে, অনাহারে, দুর্ভিক্ষে - ১৭৯৮ সালে, অর্থনীতিবিদ রবার্ট ম্যালথাস এই কথা বলে সবাইকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন । শুধু ম্যালথাসই নয়, এরকম কথা আমরা কিছুদিন আগে পর্যন্তও শুনে এসেছি বহু বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে।
তবে সেই ভবিষ্যৎবাণীগুলো কিন্তু ফলেনি। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে জনসংখ্যা বিদুতগতিতে বেড়েছে- কিন্তু একই সাথে শিল্প বিপ্লবের ফলে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির উদ্ভাবনের কারণে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খাদ্য উৎপাদনও।
অবশ্য, অনাহারে, দুর্ভিক্ষে কোটি কোটি মানুষও মারা গেছে - তবে... তার কারণ জনসংখ্যা বিস্ফোরণ নয় বরং খাদ্যের অসম বণ্টন। এটা ঠিক যে, আজকের পৃথিবীতে আমরা যত মানুষ দেখছি তা আমাদের দুই লাখ বছরের বিবর্তনের ইতিহাসে কোনদিনও ছিল না, এবং এটা আমাদের ছোট্ট এই গ্রহের জন্য অন্যতম একটা বড় সমস্যা তো বটেই।
এখন প্রশ্ন হলো, ১৮ শতাব্দীতে এসে হঠাত করে কেন এভাবে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ঘটতে শুরু করলো? কৃষির উদ্ভাবনের পর থেকে শিল্পবিপ্লবের আগে পর্যন্ত জনসংখ্যা বাড়লেও তা কিন্তু তেমন বেশি হারে বাড়েনি। কিন্তু ১৮ শতক থেকে তার আমুল পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। এখন দেখে মনে হতে পারে, য, শুধু আমাদের মত অনুন্নত দেশগুলোতেই বুঝি হুহু করে জনসংখ্যা বাড়ে কিন্তু এই তো এক শতাব্দী আগে পর্যন্তও ইউরোপ, আমেরিকাসহ সমগ্র পৃথিবীতেই গড়ে একজন নারী ৫ থেকে ৬ জন শিশুর জন্ম দিতেন।
এর কারণ আর কিছুই নয় - তখন জন্ম নেওয়া শিশুদের অর্ধেক বা অর্ধেকের বেশি ৫ বছর বয়েস হওয়ার আগেই মারা যেত, এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থাও জানা ছিল না আমাদের - তাই মানুষও তখন, অন্যান্য প্রাণীর মতই প্রাকৃতিকভাবেই, সর্বোচ্চ সংখ্যক শিশুর জন্ম দিত।
তারপর, বিশ্বব্যাপী গড়ে তোলা উপনিবেশগুলো থেকে আহরণ করা সম্পদে উন্নত হয়ে ওঠে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ - ঘটে শিল্প বিপ্লব - তাদের সামগ্রিক জীবনমানেও উন্নতি ঘটতে শুরু করে - একদিকে আয়ু বাড়ে আবার অন্যদিকে শিশু মৃত্যুর হারও কমতে শুরু করে - এর ফলে প্রথমবারের মত মানুষের ইতিহাসে শুরু হয় জনসংখ্যার
অকল্পনীয় উর্দ্ধগতি।
১৭৫০ থেকে ১৮৫০ এর মধ্যে বৃটেনের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল । তারপরে ..
ধীরে ধীরে শিক্ষা, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা, এন্টিবায়োটিক, টিকা, জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির আবিষ্কার থেকে শুরু করে সার্বিক অগ্রগতির ফলে পশ্চিমা দেশগুলোতে জনসংখ্যা দ্রুত কমে আসতে শুরু করে।
গত ২০০-৩০০ শ' বছরে বিশ্বব্যাপী দেখা গেছে, একটা দেশে শিল্পায়ন এবং উন্নয়ন শুরু হলে পুষ্টিকর খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং স্যানিটেশনের উন্নতি হয় মানুষের আয়ু বাড়ে, শিশু মৃত্যু হার কমতে থাকে। সুযোগ সুবিধাগুলো শুধু ধনীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে অসম হারে হলেও ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ জনগণের মধ্যেও।
আর তার পরে, ধীরে ধীরে... বাল্যবিবাহ বন্ধ, নারী শিক্ষা, নারী অধিকার, জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রসারের ফলে সেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও দ্রুত কমে আসতে থাকে।
তবে আমেরিকা এবং ইউরোপে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটলেও এশিয়া বা আফ্রিকার উপনিবেশগুলোতে সেই উন্নয়ন ঘটতে দেওয়া হয়নি। সাম্প্রতিককালে আমরা দেখেছি, স্বাধীনতার পরে কীভাবে বাংলাদেশে, কয়েক দশকেই জন্মহার ৭ থেকে ২.২ এ নেমে এসেছে। একই ঘটনা দেখা গেছে, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, ইরানসহ বহু উন্নয়নশীল দেশেও । আবার চীন বাধ্যতামূলকভাবে এক সন্তানের নিয়ম করে তাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছে - যদিও জনসংখ্যার দ্রুত নিম্নগতি এখন তাদের জন্য এক বিশাল চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে আফ্রিকা মহাদেশে এখনো জনসংখ্যা বাড়ছে সাঙ্ঘাতিক গতিতে। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের বিশটি সর্বাধিক জনবসতিপূর্ণ দেশের মধ্যে ১৫টিই হবে আফ্রিকাতে। কেন আফ্রিকাতে এখনো জনসংখ্যা বিস্ফোরণ অব্যাহত আছে?
এর প্রধান কারণ হলো আফ্রিকার দেশগুলো ঔপনিবেশিক বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসেছে আরো পরে। আবার স্বাধীনতার সময় সেখানে যেভাবে রাষ্ট্রগুলোর লাইন টানা হয় তাতে করে বহু দেশই জড়িয়ে পড়ে দীর্ঘমেয়াদী গৃহযুদ্ধে। এর ফলে আফ্রিকার উন্নয়নও পিছিয়ে পড়েছে এশিয়া বা দক্ষিন আমেরিকার বহু দেশের তুলনায়।
তাহলে চলুন দেখা যাক এই মুহূর্তে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা কোন দিকে যাচ্ছে!
বিংশ শতাব্দীতে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটেছিল, সে সময়ে জন্ম নেওয়া সেই মানুষগুলো এখন দীর্ঘদিন বেঁচে থাকছেন। সে কারণে এখন জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার মাত্র ২.১ বা ২.২ এ নামিয়ে আনলেও আরো বেশ কয়েক দশক ধরে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা বাড়তেই থাকবে। জাতিসংঘ বলছে, ২০২৩ সালে জনসংখ্যা হবে ৮ বিলিয়ন, বা ৮০০ কোটি, ২০৩৭ সালে ৯০০ কোটি, ২০৫৭ সালে ১০০০ কোটি এবং ২১০০ সালে তা গিয়ে দাঁড়াবে ১১০০ কোটিতে।
তারপরে? হ্যাঁ তারপরেই... কমতে শুরু করবে জনসংখ্যা।
এমনকি কেউ কেউ বলছেন, আরো আগেই, ২০৬৪ সাল নাগাদই পৃথিবীর জনসংখ্যা বেড়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে ৯৭৩ কোটিতে পৌঁছে কমতে শুরু করে দেবে । ২১০০ সাল নাগাদ তা কমে ৮৭৯ কোটিতে পৌঁছাবে। এবং তারপরে ক্রমাগতভাবে কমতেই থাকবে। এই নিম্নগামী জন্মহার পৃথিবীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক বা পরিবেশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। যেমন ২০৫০ সাল নাগাদ উন্নত দেশগুলো তো আছেই সেই সাথে বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া বা ভিয়েতনাম সহ অনেক দেশেই ষাটোর্ধ মানুষের সংখ্যা তিন গুণ হয়ে যাবে। একটা দেশে মোট কর্মক্ষম মানুষের চেয়ে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেলে যথেষ্ট পরিমানে ট্যাক্স আসবে কোত্থেকে? এই বিরাট সংখ্যক অবসপ্রাপ্ত মানুষের পেনশন, চিকিৎসার খরচ কে যোগাবে?
একদিকে বৃদ্ধ জনগোষ্ঠী, অন্যদিকে কর্মক্ষম মানুষের অভাব এই টানাপোড়নে হয়তো কোটি কোটি রোবটের প্রয়োজন পড়বে। তবে আশা করা যায়, ছোট জনগোষ্ঠী কম কার্বন ছড়াবে বাতাসে, চাষাবাদের চাপ কমে যাবে, বন-জঙ্গল কম কাটা হবে। তবে আগামীতে জনসংখ্যা কমবে সেই আশাতে বসে না থেকে আমাদের এখন থেকেই জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলাতে হবে; ভোগের মাত্রা, সম্পদের অসম বন্টন এবং পরিবেশ ধ্বংস করা কমিয়ে আনতে হবে, renewable energy বা নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে - আমাদের পূর্বসূরীদের মত আবারও পৃথিবীটাকে ভাগ করে নিতে শিখতে হবে অন্যান্য সব জীবের সাথে।
ত্রুটি স্বীকার: ৪:৫৪ মিনিটে প্রজনন হারের (fertility rate) বদলে ভুলক্রমে জন্মহার (population growth rate) বলা এবং দেখানো হয়েছে। এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। বাংলাদেশের জন্মহার (population growth rate) বর্তমানে ১.১ এর কাছাকাছি, যা সত্তরের দশকে ২.৭-এর কাছাকাছি ছিল।
References:
The No-nonsense Guide to World Population by Vanessa Baird
World Population by Geoffrey Gilbert (2nd ed.)
Articles cited:
https://www.theguardian.com/world/2021/jan/24/as-birth-rates-fall-animals-prowl-in-our-abandoned-ghost-villages
https://www.unfpa.org/gender-biased-sex-selection
https://www.pewresearch.org/fact-tank/2019/06/17/worlds-population-is-projected-to-nearly-stop-growing-by-the-end-of-the-century/
https://www.theguardian.com/global-development/2018/apr/23/population-how-many-people-can-the-earth-sustain-lucy-lamble
https://www.worldometers.info/world-population/#table-historical
https://www.theworldcounts.com/stories/how-many-babies-are-born-each-day
https://www.nytimes.com/2016/02/27/world/asia/japan-confirms-a-decline-in-population.html?utm_source=pocket_mylist
https://www.bbc.com/news/health-53409521?utm_source=pocket_mylist
https://www.cnbc.com/2017/05/05/stephen-hawking-human-extinction-colonize-planet.html
https://www.scientificamerican.com/article/population-growth-climate-change/