মার্চের ৮ তারিখ, ১৯৯৯ সাল। ধর্ষিত হলো ৩ বছরের এক শিশু, যার ছদ্মনাম আসমা। সেই শিশু আসমা আজ ২৪ বছরের তরুণী। ২১ বছর পরে, এখনো, মামলার তারিখে, আদালত চত্বরে হাজির হন তিনি, এখনো ঘোরেন আদালতের দ্বারে দ্বারে, বিচারের আশায়। এরকম হাজারো আসমার ধর্ষণের খবরে সয়লাব আমাদের খবরের কাগজগুলো আজকাল, এটাই এখন আমাদের সমাজের করুণ বাস্তবতা। এবছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত, শুধুমাত্র রিপোর্ট করা হিসেব থেকে জানা যাচ্ছে, ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬০১ জন নারী ও শিশু। ১০৩ জনের বয়স ১২ বছরের নিচে, ৪০ জনের বয়স মাত্র ৬ বছর! ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৭ জনকে, আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন, বাদ যায়নি প্রতিবন্ধী এবং বয়স্ক নারীরাও৷ ইদানীং ছেলে শিশুরাও ধর্ষণের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন।
ভাবছেন ২০২০ সালটা বড্ড বেশি খারাপ ছিল? আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালে, ১ হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০০১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত, ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে
- চিকিৎসা নিতে আসেন, ২২ হাজার ৩৮৬ জন
- মামলা হয় ৫,০০৩ টি
- আর রায় হয়? ৮০২টি ঘটনায় ৷
- রায় ঘোষণার হার ৩ দশমিক ৬৬ ভাগ।
- শেষ পর্যন্ত শাস্তি পেয়েছে কয়জন শুনবেন? ১০১ জন৷
আরেকটি পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত দেশের ৬টি জেলায় ৪,৩৭২ টি মামলায় মাত্র ৫ জন ধর্ষকের শাস্তি হয়। প্রথম আলোর গবেষণা বলছে, ধর্ষণ মামলায় সাজার হার ৩ শতাংশ।হ্যাঁ, ১০০ জনে ৩ জন অভিযুক্ত। ধর্ষক শাস্তি পায় না আমাদের বিচারব্যবস্থায়। যে-বিচারহীনতার সমাজে ধর্ষকদের শাস্তি হয় না, আর তাদের পক্ষে থাকে সমাজ, রাষ্ট্র ও ক্ষমতাসীনদের প্রশ্রয়, সেখানে অবাধে ধর্ষণ এবং যৌন নিপীড়ন ঘটাটা কি খুব অস্বাভাবিক? ধর্ষণ সংস্কৃতি যেখানে ছড়িয়ে আছে সমাজের আনাচে কানাচে, দুই একজন ধর্ষকের ফাঁসি হলেই এই কুৎসিত ব্যাধির সমাধান হয়ে যাবে এই গ্যারান্টিটাই বা কে দিচ্ছে?
একটু আগে যে-পরিসংখ্যানগুলো দেখলাম, তা ধর্ষণের বা যৌন নির্যাতনের সার্বিক চিত্রটা কোনোভাবেই তুলে ধরে না। আমাদের মত দুর্নীতিপরায়ণ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কতজন নারী পুলিশের কাছে যেতে সাহস পান? আর তার মধ্যে ক’টা কেসইবা আমাদের কান পর্যন্ত এসে পৌঁছয় বা সরকারি-বেসরকারি পরিসংখ্যানে যোগ হয়? লোকলজ্জা এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার ভয়ে, প্রতি ৩টি ধর্ষণের মধ্যে ২টিরই বিরুদ্ধে নাকি কোন মামলা হয় না। তার মানে আমরা যা শুনছি তার চেয়ে কমপক্ষে কয়েকগুণ বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। আজকে এই সমস্যার গোড়ায় গিয়ে ভাবা দরকার। কেন একটা মেয়েকে ধর্ষণ বা বিবস্ত্র করে তার ভিডিও ধারণ করে তাকে ব্ল্যাকমেইল করা যায়? চুরি, ডাকাতি, হত্যার ভিডিও করে কি কোনো অপরাধী ভিক্টিমকে ব্ল্যাকমেইল করতে সাহস পাবেন? তাহলে একটা মেয়ের সাথে এই বীভৎস অপরাধ করে, উল্টো সেটা দিয়েই তাকে ব্ল্যাকমেইল করে বীরত্ব ফলানোর সাহস কেন পায় ধর্ষকেরা? এ সাহস দেয়一আর কেউ নয়一স্বয়ং আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্র।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকেই দোষী করা হয়, মেয়েটির বিরুদ্ধেই আঙুল তোলা হয়, শুরু হয় ভিক্টিম ব্লেমিং: কেমন কাপড় পরে ছিল, কার সাথে ঘুরেছিল, কেন কোন সময়ে বের হয়েছিল? যেন মেয়েদের আবার অন্তঃপুরে ঢুকিয়ে ফেলতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অথচ, বেশির ভাগ ধর্ষণই ঘটান পরিচিতেরা। ওদিকে আবার পুলিশের কাছে গেলেও মামলা নিতে অস্বীকার করে। ধর্ষক যদি প্রভাবশালী কেউ হয় তাহলে তো কথাই নেই, ধর্ষিতার পরিবারের উপর হুমকি-ধামকি, ঝক্কি-ঝামেলারও শেষ থাকে না। আমাদের দেশের কোন মেয়ে কি আছেন, যিনি রাস্তাঘাটে, পাড়ায়, বাসে, বাসায়, শিক্ষাঙ্গনে ইভ টিজিং, যৌন হয়রানির শিকার হননি বা কাউকে শিকার হতে দেখেননি? আমরা এটাতে এতটাই অভ্যস্ত যে একে আর কোন অপরাধ বলে ভাবতেও ভুলে গেছি।
বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে সিনেমায় নারীকে পণ্য হিসেবে দেখানো তো স্বাভাবিক ঘটনা, বলিউড, ঢালিউডের সিনেমায়, নায়কের নায়িকাকে উত্ত্যক্ত করা, ধর্ষণের সিন দেখিয়ে পুরুষত্বের মাস্তানি, দূষিত পুরুষালিপনাকে মহিমান্বিত করার ঘটনাও বিরল নয়। ওদিকে আবার ওয়াজ মাহফিলে নারীদের যেভাবে কামনার ও ঘৃণার বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, তেঁতুলের সাথে তুলনা করা হয় সেটাই বা বাদ যায় কী করে একটা জাতির সামগ্রিক সাইকি বা মনোভঙ্গি থেকে? আমাদের গালাগালিগুলোর কথাই একবার ভেবে দেখুন না। পুরুষ হলে মা, বোন, বউকে নিয়ে হিংস্র যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ গালি দেবেন, আর নারী হলে? তার চরিত্রহানি করে তথাকথিত 'খারাপ মেয়ে' হিসেবে দেখাতে পারলে গালি-প্রদানকারীর শুধু সন্তুষ্টিই নয়, জিতও নিশ্চিত। ভাষায়, লেখায়, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, সিনেমায়, রাস্তাঘাটে এই নিত্যদিনের মানসিকতা ধর্ষণ সংস্কৃতিরই বহিঃপ্রকাশ।
এবার এই শ্বাসরোধী বিচারহীনতা আর পুরুষতান্ত্রিক কদর্য সংস্কৃতির সাথে যোগ করুন ক্ষমতাবানদের এবং ক্ষমতাসীন-রাজনৈতিক নেতাদের প্রশ্রয় এবং তাদের সম্পৃক্ততা। গত কয়েক মাসেই দেখেছি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা কিভাবে এসব ধর্ষণের সাথে সরাসরি জড়িত! সামরিক সুরক্ষিত স্থানে তনুর ধর্ষণ এবং হত্যা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সিলেট, নোয়াখালির মত অসংখ্য ধর্ষণের খবর পাওয়া গেলেও, বিচার হয়েছে এমন খবর ক'টা পেয়েছেন? কতটুকু বিচলিত হয়েছে সরকার বা নির্বাহী ও বিচারবিভাগ এসব নিয়ে? আর পাহাড়ের ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে তো মহাভারত লেখা যায়। এ যেন এক স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে আমাদের জাতির ইতিহাসে।
অর্থাৎ সুরক্ষিত ক্যান্টনমেন্ট হোক, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে নিজের ঘর, কাজ, স্বামীর সাথে বেড়াতে যাওয়া, পহেলা বৈশাখ উদযাপন বা অরক্ষিত অন্ধকার গলি পর্যন্ত, কোথাও নেই সামান্য নিরাপত্তা। বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ বা রুয়ান্ডার গৃহযুদ্ধে আমরা দেখেছি, যুদ্ধের সময় ধর্ষণকে মারাত্মক এক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে শত্রুপক্ষ। কিন্তু একটা স্বাধীন দেশে যখন সমাজ, রাষ্ট্র এবং ক্ষমতাসীনেরা নিজেরাই এর অংশ হয়ে যায়, তখন এই বর্বরতাকে কী বলবেন? সামগ্রিকভাবে আমাদের দেশে এত নারী ক্ষমতার শীর্ষে থাকার পরেও এই যে নারীদের ওপর আদিম, পৈশাচিক নিপীড়নের ঢল বয়ে যাচ্ছে সেটাকেই বা কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন? কাদের প্রতিনিধিত্ব করেন এই ক্ষমতাসীন নারী এবং পুরুষেরা? ক'টা পাড়ায় গড়ে উঠেছে ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ? কোন স্কুল কলেজের পাঠ্যসূচিতে যোগ করা হয়েছে যৌন শিক্ষা, ছেলেমেয়েদের মধ্যে স্বাভাবিক, সুস্থ যোগাযোগের ব্যবস্থা?
যে দেশে কথায় কথায়, অনুভূতিতে আঘাত লাগে, মামলা হয়, সেখানে একবারও শুনেছেন ওয়াজ মাহফিলে-ধর্মীয় নেতাদের বক্তব্যে নারীদের প্রতি বিষোদ্গারের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে? রাস্তাঘাটে সারাক্ষণ যে মেয়েরা হয়রানির শিকার হয় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? প্রচলিত আইনে ধর্ষণের বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার সমাধানে কে এগিয়ে এসেছে? অথবা ধরুন, ধর্ষণের খবর ভাইরাল না হওয়া পর্যন্ত কেনই বা আমাদের কারোর টনক নড়ে না? এই নৃশংস বর্বরতার বিরুদ্ধে সারা দেশব্যাপী সাধারণ নারী ও পুরুষেরা আজ যে বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদ শুরু করেছেন তা এই অন্ধকার সময়েও আশার আলো জ্বালায়। শুধু দুই একজন ধর্ষকের ফাঁসি দিয়ে বা পুরুষাঙ্গ কাটার দাবি করে এই সমস্যার সমাধান হবে না। এর সমাধানের জন্য দরকার পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার; শিক্ষা এবং সচেতনতা; নারী, নারী-পুরুষের সমানাধিকার এবং যৌনতার প্রতি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আর তার বাস্তবায়নে রাজনীতিবিদ এবং ক্ষমতাসীনদের সদিচ্ছা।