মেরুর বিশাল সব হিমবাহ গলে যাচ্ছে, দুনিয়াজোড়া বান ডাকছে, বাংলাদেশ বা নেদারল্যান্ডসের মত নিম্নাঞ্চলের দেশগুলো থেকে শুরু করে ডুবে যাচ্ছে নিউ ইয়র্ক, মায়ামি, জাকার্তা, ব্যাংকক, ভেনিস - জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কথা শুনলেই আমাদের চোখে এরকম একটা ছবি ভেসে ওঠে - এক্কেবারে হলিউডের কোনো এপোক্যালিপ্টিক মুভির মত।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মেরুর বরফ গলে গিয়ে নিম্নাঞ্চলগুলোর ডুবে যাওয়াই কি আমাদের জন্য একমাত্র সমস্যা? যদি বলি - না, এটাই সবচেয়ে বড় বিপর্যয় নয়?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মেরুর সব বরফ গলে গেলে পৃথিবীর নীচু জায়গাগুলোর ডুবে যাওয়া ছাড়াও আরো অনেক বড় বড় সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে আমাদের।
আসুন থিংকের এই ভিডিওতে, আমেরিকার জ্যাক্সন-ভিল ইউনিভার্সিটির, ইমারজেন্সি ম্যানেজমেন্টের প্রফেসর এবং ডিপার্টমেন্টের প্রধান ড. তানভীর ইসলামের কাছ থেকে জেনে নেই - মেরুর বরফ গলে গেলে কত বড় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে মানবসভ্যতা এবং সমগ্র জীবজগতের উপর।
আলোচনা শুরু করার আগে একটা ছোট্ট অনুরোধ, আমাদের ভিডিও প্রকাশের সাথে সাথে নোটিফিকশন পেতে নীচের সাবস্ক্রাইব বাটনে এবং বেল আইকনটিতে ক্লিক করুন।
বেশ কয়েক দশক ধরেই বিজ্ঞানীরা কিন্তু আমাদের সতর্ক করে আসছেন জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে কিন্তু ওটা নিয়ে আমরা খুব একটা মাথা ঘামাইনি, এমনকি এখনও তেমন কোন ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে না পৃথিবী জুড়ে, অথচ বিজ্ঞানী এবং গবেষকেরা বলছেন - ইতোমধ্যেই বেশ অনেকটা দেরি হয়ে গেছে ।
আজ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে তীব্র দাবানল, জার্মানি, ভারত, চীন, নাইজেরিয়া, উগান্ডায় প্রবল বন্যা, মাদাগাস্কারের দীর্ঘ খরা, পৃথিবীব্যাপি আরও শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, সাইবেরিয়ায় অত্যন্ত দ্রুত গলতে থাকা পারমাফ্রস্ট, বা কানাডা- আমেরিকার পশ্চিম দিকে অবিশ্বাস্য রকমের গরমে মানুষ ও গবাদি পশু মারা যাওয়া ছাড়াও অত্যন্ত দ্রুত হারে গলে যেতে শুরু করেছে মেরুর হিমবাহ।
জলবায়ুসংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক প্রকাশনার ১০০টার মধ্যে ৯৭টাতেই বৈজ্ঞানিকেরা এই বরফ গলার জন্যে দায়ী করছেন মানুষের কাজকর্মকে।
আমরা থিংকের জলবায়ু পরিবর্তনের এই ভিডিওতে জেনেছিলাম জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার কারণ সম্পর্কে এবং এবং এও দেখেছিলাম যে আমাদের প্রকৃতি জটিলভাবে কাজ করে - তাই দীর্ঘমেয়াদি দুর্যোগগুলো ঠিক কিভাবে নেমে আসবে সেটা আমরা এক্কেবারে নির্দিষ্ট করে বলতে পারি না ঠিক যেমনভাবে ধরুন, কোভিডের ১৯-এর মত অতিমারী যে ঘটবে সেটা বিজ্ঞানীরা অতীতে বলে থাকলেও তার সময়, মাত্রা বা ব্যপ্তি নিয়ে আগে থেকে ভবিষদ্বাণী করা সম্ভব হয়নি।।
তবে একটা ব্যাপারে সবাইই একমত - সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে মেরুর বরফ গলার কারণে।
১৯৯০-এর দিকে পৃথিবীতে প্রতি বছরে বরফ গলত ৭৬০ বিলিয়ন টন। ২০১০ থেকে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে বছরে ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন টনে। আমাদের জীবদ্দশাতেই বেড়ে গেছে শতকরা ৬০ ভাগ ।
এখানে দেখুন কী হারে বরফ গলে যাচ্ছে উত্তর মেরুতে ১৯৭৯ সাল থেকে। মেরুতে গরমের শেষে সেপ্টেম্বর মাসে সবচেয়ে কম বরফ থাকে, এই সেপ্টেম্বরের মেরুর বরফ, ১৯৮১ থেকে ২০১০ এর তুলনায় প্রতি দশকে কমছে ১৩.১% হারে ।
সারা পৃথিবীতে আমরা যত পানি দেখি তার শতকরা ৯৭ ভাগই লবণাক্ত। আর বাকি যে ৩% মিষ্টি জল তার মধ্যে ৭০ ভাগই উত্তর বা দক্ষিন মেরুর বরফের মধ্যে বন্দী, মানে এখানে আমরা অল্প স্বলপ বরফের কথা বলছিনা, বলছি ৩০ মিলিয়ন বা ৩ কোটি কিউবিক কিলোমিটার বরফের কথা!
সমুদ্রে ভেসে থাকা বরফ গলে গেলে হয়তো সেভাবে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বেনা কারণ সে ইতোমধ্যেই পানিতে জায়াগা দখল করে আছে, কিন্তু মেরুর সব বরফ গলে গেলে তার পরিনাম হবে মারাত্মক - সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে অন্তত ৭০ মিটার বা ২৩০ ফিট, মানে প্রায় কুড়ি-বাইশতলা দালানের সমান উচ্চতার কথা বলছি আমরা।
আচ্ছা, না হয় বুঝলাম জল অনেকটা বাড়বে, তাহলে সমুদ্র উপকূল থেকে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি না কেন আম্রা?
বললেই তো আর সরে যাওয়া যায় না - পানির উৎসের কাছাকাছিই আমরা গড়ে তুলেছি বেশিরভাগ সভ্যতাগুল - বিশাল সব মহানগরী- টোকিও, নিউ ইয়র্ক, সাও পাওলো, মুম্বই, লন্ডন, ব্যাংকক, ইস্তাম্বুল। পৃথিবীর জনবসতির প্রায় অর্ধেকটাই, প্রায় ৪০০ কোটি মানুষ বাসা বেঁধেছে সেখানে।
সমুদ্রের উচ্চতা ১ মিটার বাড়লেই বড় সমস্যার সম্মুখীন হব আমরা।
আর ১০ মিটার বাড়লে? পৃথিবীর শতকরা ১০ ভাগ জনবসতি মানে ৭০-৮০ কোটি মানুষকে উপকূল এলাকা থেকে সরিয়ে নিতে হবে।
২৫ মিটার বাড়লে সরাতে হবে শতকরা ২০ ভাগ।
আর পুরো ৭০ মিটার বাড়লে?
শুধু বাংলাদেশই নয়, মায়ামি, লন্ডন, ভেনিস, নেদারল্যান্ডসের অস্তিত্বই থাকবে না, ডুবে যাবে উত্তর চিনের বেশিরভাগটা, অস্ট্রেলিয়ায় তৈরি হবে নতুন একটা সাগর, আফ্রিকার বেশিরভাগ জায়গায় তাপমাত্রা এমন বাড়বে যে মানুষ টিকতেই পারবে না।
আরেকটি বিশাল বড় সমস্যা হল সামুদ্রিক-স্রোত!
সমুদ্রস্রোত আমাদের জীবনযাত্রার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে যেটা আমরা অনেক সময় দৈনন্দিন জীবনে বুঝতে পারিনা। এই স্রোত আবহাওয়া, জলবায়ু, এমনকি শ্বাসের সাথে আমরা যে-অক্সিজেন নেই সেটাও সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে।
সমুদ্রস্রোত আর বায়ুপ্রবাহ মিলে বিষুবীয় অঞ্চল থেকে পৃথিবীর তাপটা ->উত্তরে শীতল মেরু প্রদেশের দিকে নিয়ে যায়, অনেকটা ইঞ্জিনের মত - এটাকে বলা হয় থার্মোহ্যালাইন সার্কুলেশন সিস্টেম। থার্মোস মানে তাপমান আর হ্যালাইন অর্থ লবণের পরিমাণ আর এই দুটো মিলে পানির ঘনত্বটা ঠিক করে।
যেমন ধরুন, লন্ডন শহরটা কানাডার ক্যুবেকের মত একই অক্ষাংশে, কিন্তু ক্যুবেক ভীষণ ঠান্ডা আর সে-তুলনায় লন্ডনের গড় তাপমাত্রা উষ্ণই বলতে হয়। এর কারণ হল, এই বিপুল মহাসাগর পরিচলনের একটা অংশ হিসেবে উপসাগরীয় স্রোত বিষুবীয় অঞ্চল থেকে ইউরোপের দিকে গরম জল নিয়ে যাচ্ছে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সব বরফ গলে সমুদ্রে মিশলে সমুদ্রের লবণাক্ততা কমে যাবে, এর ফলে কমে যাবে সমুদ্রের জলের ঘনত্ব! আর তা প্রভাবিত করবে এই থার্মোহ্যালাইন পরিবহনকে - অর্থাত এখন যেভাবে সমুদ্রের শীতল জল ঘন লবনাক্ত জলের গভীরে ডুবে যায় তখন তা আর সেভাবে ঘটবেনা , এর ফলে সারা পৃথিবীর মহাসাগর পরিচলনটাও আর ঠিকভাবে কাজ করবে না।
আবার ওদিকে ভারতীয় উপমহাদেশে সমুদ্রস্রোত লন্ডভন্ড হয়ে গেলে ভারতীয় বার্ষিক মৌসুমী বায়ুর ওপর প্রভাব পড়বে, দেখা দেবে বিধ্বংসী বন্যা, খরা। একইভাবে আফ্রিকায় মৌসুমী বায়ুর ওলটপালট ঘটলে সেখানে দেখা দিতে পারে আরো ভয়ংকর খরা।
বদলে-যাওয়া সমুদ্রস্রোতের কারণে নাটকীয়ভাবে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করবে- ঘূর্ণিঝড়গুলো আরো শক্তিশালী হবে, কোন জায়গায় বাড়বে বৃষ্টি, আবার কোথাও দেখা দেবে অনাবৃষ্টি - যা কৃষির জন্যে খুব বিপজ্জনক, বাড়বে দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য। বিশাল গণঅভিবাসনের ধাক্কায় তৈরি হতে পারে চরম রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা - ২০৫০ এর মধ্যেই ১ বিলিয়ন মানুষ পরিণত হতে পারে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে।
ওদিকে আবার দেখুন সমুদ্রের ক্ষুদে উদ্ভিদ আর প্ল্যাঙ্কটন থেকে পৃথিবীর অক্সিজেনের অর্ধেকটা আসে। মহাসাগরের এই পরিচলনের সমস্যার কারণে স্রোতের সাথে পুষ্টিকণাগুলোও ভেসে যাবে, এর ফলে, আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যা তো হবেই, অনেক সামুদ্রিক প্রাণী ও উদ্ভিদ বিপন্ন এমনকি নিশ্চিহ্নও হয়ে যাবে, সংকট দেখা দেবে আমাদের খাদ্য সরবরাহে।
শুধু অক্সিজেন নিয়েই সমস্যা তাই কিন্তু নয় নয়, পারমাফ্রস্ট থেকে বরফ গলার ফলে সেখানকার মাটির ব্যাক্টেরিয়গুলো বাতাসে প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড ছাড়বে এর ফলে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ আরো অনেক বেড়ে যাবে। মহাসাগর পরিচলনের উপর ঠিক কীভাবে প্রভাব পড়বে এ নিয়ে যদিও বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই থার্মোহ্যালাইন পরিচলন পদ্ধতিতে গোলমাল ঘটলে যে তার ফলাফল মোটেও ভালো হবেনা এ নিয়ে কিন্তু কোন সন্দেহই নেই।
আমরা যদি আজকের হারে জীবাস্ম জালানি ব্যবহার করতে থাকি এবং জল্বায়ু পরিবর্তন রোধে সক্রিয় না হই তাহলে কয়েক হাজার বছরের মধ্যে গলে যাবে সব বরফ যা থেকে মানবসভ্যতা এবং সমগ্র জীবজগতের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়ে যেতে পারে। তাই অনুগ্রহ করে ভিডিওটা ছড়িয়ে দিন, জানিয়ে দিন সবাইকে, গড়ে তুলুন সচেতনতা, বিশ্বব্যাপী বাড়ান সরকারের ওপর চাপ, সক্রিয় হোন জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করতে।