চাঁদ না থাকলে পৃথিবীর কী হতো? কীভাবে জন্ম নিয়েছিলো চাঁদ?

.

সাড়ে চারশ কোটি বছর আগে আমাদের সৌরজগত এবং পৃথিবী সৃষ্টির ঠিক পরের কথা, মানে মাত্র ৫০ লক্ষ থেকে এক কোটি বছর পরের গল্প। তখনো আমাদের পৃথিবী ঠিক ঠান্ডা হয়ে ওঠেনি, তার বেশিরভাগই গলিত লাভা, মহাকাশ থেকে তখনো আছড়ে পড়ছে হাজারো গ্রহাণু! আজ আকাশে সূর্যের সাথে চাঁদকেও দেখতে দেখতে দেখতে  মনে হয় যেন এই চাঁদ সবসময়েই ছিল! তখন কিন্তু চাঁদ ছিল না - পৃথিবী একাই ছিল তখন।  


তাহলে চাঁদ এলো কোথা থেকে?  চাঁদ ছাড়া পৃথিবীই বা কেমন হতো? 


বিজ্ঞানীরা মনে করেন, চাঁদের সৃষ্টি হয়েছিল এক প্রকাণ্ড সংঘর্ষ থেকে - যে সে সংঘর্ষ নয়, ছোট কোনো উল্কাপিণ্ড বা গ্রহাণুর আঘাত  নয় - দানবীয় এক সংঘর্ষ - এবং তার ফলে বদলে গেছে  আমাদের পৃথিবীও চিরতরে। আজ আমরা পৃথিবীকে যেমনটা দেখি, সেরকম হতো না আমাদের এই ছোট্ট নীল গ্রহটা এভাবে চাঁদের উৎপত্তি না ঘটলে। যেভাবে প্রাণের বিকাশ ঘটেছে, আমাদের বিবর্তন ঘটেছে, তাও হয়তো হতো না, বা হলেও হতো অন্যভাবে। 


চলুন তাহলে আজকে জেনে নেওয়া যাক রোমাঞ্চকর এনিমেশনসহ সেই বিধ্বংসী সংঘর্ষের গল্পটা।  


চাঁদ নিয়ে, চাঁদের উৎপত্তি নিয়ে মানুষের আগ্রহ সেই আদি থেকে, কত কিছুই না কল্পনা করেছে মানুষ তাকে নিয়ে। খ্রীষ্টপূর্ব ৪৫৫ গ্রীক দার্শনিক এনাক্সাগোরাস বলেছিলেন, চাঁদ সম্ভবত পাথরের তৈরি এবং আমাদের পৃথিবীরই একটা অংশ ভেঙ্গে সৃষ্টি হয়েছিল তার। শুধু তাই নয়, তিনি এও বলেছিলেন যে সূর্যের আলোতেই আলোকিত হয় চাঁদ, তার নিজের কোনো আলো নেই। কিন্তু এনাক্সাগোরাস তার সময় থেকে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন, তখন সবাই চাঁদকে দেবতা হিসেবে ভাবতেই পছন্দ করতো। তাই তার সেই চিন্তা হারিয়েই গিয়েছিল। 


তারপরে তার সেই তত্ত্ব আবার সামনে আসে ২৩০০ বছর পরে, যখন প্রকৃতিবিদ চার্লস ডারউইনের ছেলে  জ্যোতির্বিদ জর্জ ডারউইন উনিশ শতাব্দীতে বলেন, পৃথিবীর দ্রুত ঘূর্ণনের ফলে পৃথিবীর এক অংশ ভেঙ্গে আলাদা হয়ে চারদিকে ঘুরতে শুরু করে এবং সেটাই একসময় পরিণত হয় চাঁদে। 


আরো বহু অনুকল্প দেওয়া হয়েছিল এর মধ্যে, যেমন ধরুন, দখল তত্ত্ব - গ্রহাণুর মতো কোনো মহাকাশীয় বা খগোল বস্তু কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় পৃথিবীর মাধ্যকর্ষণে আটকা পড়ে চাঁদে পরিণত হয়।  যেটা ঘটেছে আমাদের সৌরজগতের অন্য কিছু গ্রহের চাঁদের ক্ষেত্রে। আবার ওদিকে এক্রিশান তত্ত্বমতে পৃথিবী সৃষ্টির সময়েই সেই সাড়ে চার বিলিয়ন বছর আগে একইসাথে পৃথিবী এবং চাঁদের সৃষ্টি হয়। 


১৯৬৯ সাল থেকে এপোলো চন্দ্রাভিযানে নভোচারীরা প্রায় ৩৮২ kg পাথর নিয়ে আসেন চাঁদ থেকে, শুরু হয় দীর্ঘ পরীক্ষা নিরীক্ষা। দেখা যায়, চাঁদের পাথর  আর পৃথিবীর ভূত্বকের উপরের অংশের মধ্যে অনেক মিল!  অথচ অন্যান্য যে গ্রহাণু এসে পড়ে পৃথিবীতে, তাদের গঠন কিন্তু বেশ অন্যরকম - তাহলে তো মহাকাশের অন্য দিক থেকে আসা খগোল বস্তু নয় আমাদের চাঁদ - তাদের নিশ্চয়ই একটা কমন ইতিহাস আছে! অর্থাৎ দখল তত্ত্ব ঠিক নয়!  আবার দেখা যাচ্ছে, চাঁদের পাথরগুলো এতটাই বেশি পোড়া যে তাদের মধ্যে পৃথিবীর পাথরের মতো বাষ্পীভূত হওয়ার ক্ষমতাও আর নেই। আবার  চাঁদের ভূত্বকের বেশ নিচ পর্যন্ত পদার্থ একসময়ে গলিত অবস্থায় ছিল, এর জন্য যে পরিমাণ শক্তির দরকার হয়, তা এক্রিশনের ফলে সম্ভব নয়। 


তাহলে কী খুব বড় কোনো বিধ্বংসী আঘাত থেকে সৃষ্টি হয়েছে চাঁদ? 


৭০ এবং ৮০ র দশকে বহু তর্ক চলতে থাকে বিজ্ঞানীদের মধ্যে এবং এক সময় বিজ্ঞানীরা সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব হিসেবে মেনে নেন জায়েন্ট ইম্প্যাক্ট হাইপোথিসিসকে, বাংলায় বললে দানবীয় বা বিশাল আঘাত অনুকল্প। যত দিন যাচ্ছে এবং আরো উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে, ততই এই প্রকল্পের পক্ষে প্রমাণগুলো শক্ত হয়ে উঠছে। 


কী এই জায়েন্ট ইম্প্যাক্ট বা বিশাল আঘাত অনুকল্প? 


পৃথিবী সৃষ্টির কিছুদিন পরের কথা, তখনো পৃথিবীর আজকের মত ঠান্ডা হয়ে যায়নি, তার বেশির ভাগ অংশেই  উত্তপ্ত গলিত লাভা, বিভিন্ন ধরণের গ্রহাণুর আঘাতে তখনো  জর্জরিত পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহগুলোও। আর তখনই আরেক বিশাল, মঙ্গলের মত  বিরাট এক গ্রহ বা  প্রটো-গ্রহ, যাকে অনেকে থেয়া নামেও ডাকেন,  পৃথিবীকে তির্যকভাবে, অর্থাৎ একটা কোণ করে আঘাত করে। 


চিন্তা করে দেখুন কী ঘটতে পারে এরকম দানবীয়  সংঘর্ষে - সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে শক ওয়েভ, সেই গ্রহের এক অংশ ভেঙ্গেচুরে মিশে যায় পৃথিবীর গলিত অংশের সাথে আর আরেক প্রকাণ্ড অংশ ছিটকে পড়ে মহাকাশে! যে জায়গায় সংঘর্ষ ঘটে সেখানে ৫০০০ ডিগ্রীরও বেশি উত্তাপে পাথর বাস্পীভূত হয়ে একটা অংশ  ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীকে ঘিরে চারদিকে। প্রচণ্ড আঘাতে পৃথিবীর নিজের কক্ষপথের ঘূর্ণন বেড়ে যায়, প্রতি ৫ ঘন্টায় একবার সে ঘুরে আসতে শুরু করে। 


তার আগে বলি, রোশ লিমিট (Roche Limit) বলে একটা দূরত্ব আছে। এখন, কোনো বড় খগোল বস্তু, যেমন পৃথিবীর কাছে, এই লিমিটের মধ্যে অন্য কোনো ছোট খগোল বস্ত আসে তবে বড় বস্তুটির মাধ্যাকর্ষণ বল ছোট বস্তুটিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলবে এবং সেগুলো বড় বস্তুটির ওপরে পড়বে। চাঁদের জন্য রোশ লিমিটটা হলো পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে প্রায় ১০,০০০ কিলোমিটার। তার মানে সেই দানবীয় আঘাতে পৃথিবী থেকে যে সমস্ত উৎক্ষিপ্ত পাথরখণ্ডরা ১০,০০০ কিলোমিটারের বাইরে যেতে পেরেছিল তারাই ধীরে ধীরে  ঠান্ডা হয়ে চাঁদ তৈরি করেছে, বাকি সব খণ্ডগুলো পৃথিবীর বুকে আবার ফিরে এসেছে। মনে করা হয় মোটামুটিভাবে চাঁদ পৃথিবী থেকে ২০,০০০ কিলোমিটার দূরে সৃষ্টি হয়। আর সংঘর্ষের এক শ বছরের মধ্যেই এই খণ্ডগুলো একীভূত হয়ে যায়।       


তারপরে চাঁদ ক্রমশঃ দূরে সরে যেতে থাকে পৃথিবী থেকে, বর্তমানে সে পৃথিবী থেকে প্রতিবছর প্রায় চার সেন্টিমিটার দূরে সরে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা কম্প্যুটারে সিমুলেশন করে দেখিয়েছেন যে মঙ্গলের সমান কোনো গ্রহ এসে তির্যকভাবে পৃথিবীকে আঘাত করলেই শুধুমাত্র পৃথিবী এবং চাঁদ এই গত কয়েকশো কোটি বছরে আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছাতে পারে।

আর গত দুই দশকে চাঁদ থেকে আনা পাথর নিয়ে আরো আধুনিক  গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, চাঁদ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন পদার্থের আইসোটপগুলোকে যতখানি একরকম বলে ভাবা হয়েছিল তারা আসলে তা নয়। যেমন ধরুন চাঁদের গভীরের অক্সিজেন আইসোটপগুলো  পৃথিবীর অক্সিজেন আইসোটোপের চেয়ে বেশ আলাদা আবার পৃথিবীর চেয়ে চাঁদে ভারী ক্লোরিনের পরিমাণ অনেক বেশি এবং এই গবেষণাগুলো থেকে একদিকে যেমন বোঝা যাচ্ছে যে পৃথিবীর অংশ ভেঙ্গে চাঁদের সৃষ্টি হয়নি ঠিক তেমনি আবার সাক্ষ্য দিচ্ছে সেই জায়েন্ট ইম্প্যাক্ট থিওরির পক্ষেই। 


আচ্ছা তাহলে চাঁদের কারণে পৃথিবী কতখানি বদলে গিয়েছিল? চাঁদ না থাকলে সে আজ কেমন হতো? ।                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                 থিংকের 'পৃথিবী ঘুরছে বুঝি না কেন' ভিডিওতে দেখেছি যে, পৃথিবী ও সূর্যের সঙ্গে একটি রেখা টেনে তার ওপর যদি একটি লম্ব আঁকা যায়, তার সঙ্গে পৃথিবীর অক্ষ ২৩.৫ ডিগ্রি কোণ করে আছে। ধারণা করা হয়, আমাদের এই ২৩.৫ ডিগ্রি কোণ সৃষ্টি হয়েছিল সেই দানবীয় আঘাতের ফলেই। চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ না থাক্লে পৃথিবীর অক্ষের দিক এভাবে এক অবস্থায় স্থির থাকত না, অস্থিরভাবে হয়তো ওঠা নামা করত এবং তার ফলে ঘটতো  ঋতুর চরম পরিবর্তন অথবা কোনো পরিবর্তনই নয়। ভেবে দেখুন, তা হলে আমাদের জলবায়ু কিন্তু এক্কেবারে অন্যরকম হয়ে যেত, যা জটিল প্রাণের বিবর্তন এবং  বা উদ্ভিদ বিকাশের জন্য হতো প্রতিকূল।  


চাঁদ ও কিছুটা  সূর্যের কারণে পৃথিবীর বুকে পানির এমন কি স্থলেরও জোয়ার ভাটা হয়। এই সম্বন্ধে আর বিস্তারিত জানতে আমাদের ডঃ দীপেন ভট্টাচার্যের সাথে আমাদের জোয়ার ভাটার videoটি দেখতে পারেন।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন জোয়ার ও ভাটা পৃথিবীতে উন্নত প্রাণ বিকাশে বিশেষ সাহায্য করেছে। আর এই জোয়ার ভাটার  ফলে পদার্থবিদ্যার কৌণিক ভর-বেগের সংরক্ষণের কারনে পৃথিবীর কৌণিক ভরবেগ চাঁদে স্থানান্তরিত হচ্ছে, পৃথিবীর ঘুর্ণন তার অক্ষের চারদিকে শ্লথ হচ্ছে, তার ফলে আমাদের দিনও ক্রমশঃ বড় হচ্ছে। চাঁদ না থাকলে আমাদের দিনগুলো ৫-৬ ঘন্টার বেশি হতোনা।  


আর চাঁদ? সে তো ধীরে ধীরে আমাদের থেকে দূরে সরতেই থাকবে… 


References:


https://www.pnas.org/content/117/38/23418/tab-article-info

https://pubmed.ncbi.nlm.nih.gov/23076098/

https://www.nature.com/articles/s41561-020-0550-0.epdf?

https://www.space.com/earth-moon-different-compositions-surprise.html

https://www.space.com/moon-giant-impact-theory-chlorine-isotopes


সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles