চাঁদে কি মানুষ গিয়েছিল? ষড়যন্ত্রতত্ত্ব! | Moon-landing Hoax! | Think Bangla

.

সোজা উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, মানুষ  চাঁদের বুকে হেঁটেছে।  একবার বা দুবার নয়, ছ ছ’বার। একজন বা দুইজন নন, চাঁদের বুকে হেঁটেছেন বারোজন মার্কিন নভোচারী। এ-নিয়ে আসলে সন্দেহের কোন অবকাশই নেই। তারপরও, মানুষের প্রথম চাঁদে পা দেওয়ার অর্ধ শতাব্দী পরেও, এ-নিয়ে জল্পনাকল্পনার বা ষড়যন্ত্রতত্ত্বের  কোন অভাব নেই। কিছু মানুষ এখনো মনে করেন চাঁদের অভিযানের গপ্পোটা পুরোটাই বানানো ছিল। আজকে আমরা থিংক-এর পক্ষ থেকে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত কয়েকটা অভিযোগ খণ্ডন করবো। চাঁদের অভিযানগুলোর বিরুদ্ধে, বিশেষ করে ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে নাসার এপোলো মিশনের অংশ হিসেবে নিল আর্মস্ট্রং এবং বাজ অলড্রিন যে প্রথমবার চাঁদের বুকে হেঁটেছিলেন, সেটা নিয়ে এখনো বিভিন্ন ধরণের অভিযোগ, অবিশ্বাসের  কথা শোনা যায়।    জরিপে দেখা গেছে,  শতকরা ৬ থেকে ২০ ভাগ মার্কিন, ২৬ শতাংশ ব্রিটিশ এবং ২৮ শতাংশ রুশ বিশ্বাস করেন চাঁদে যাওয়ার পুরো ঘটনাই নাকি বানোয়াট। ১৯৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেভির একজন প্রাক্তন সদস্য বিল কেসিং “We never went to the moon: America’s 30 billion dollar swindle” নামের একটি বই প্রকাশ করেন যেটা থেকেই প্রথম মনুষ্যবাহী চন্দ্রাভিযান নিয়ে সন্দেহের উদ্রেক ঘটে। ১৯৮০ সালে Flat Earth Society নাসার বিরুদ্ধে বানোয়াট  চন্দ্রাভিযানের অভিযোগ আনে এবং যুক্তি দেয় হলিউড ডিজনির প্রযোজনায়, আর্থার সি ক্লার্কের চিত্রনাট্যে এবং স্ট্যানলি কুবরিকের পরিচালনায় অ্যারিজোনার মরুভুমিতে নাকি চন্দ্রাভিযানের শুটিং করেছে।ও হ্যাঁ, এই ফ্ল্যাট আর্থ সোসাইটির লোকজনই কিন্তু এখনো মনে করে পৃথিবী গোল নয় চ্যাপ্টা! 


অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এখনো পৃথিবীতে কিছু  মানুষ বিজ্ঞানের এরকম বেসিক ব্যাপারগুলো নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন!  ১৯৭৮ সালে ক্যাপ্রিকর্ন ওয়ান নামে বানোয়াট মঙ্গল অভিযানের একটি মুভি থেকে শুরু করে ২০০১ সালে ফক্স টেলিভিশনের মত নেটওয়ার্ক পর্যন্ত চাঁদে মানুষ যাওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। চলুন তাহলে, দেখে নেওয়া যাক, চাঁদে মানুষ যাওয়ার বিষয়ে সন্দেহগুলো কী কী এবং সেই সন্দেহের অবসান ঘটানো যায় কীভাবে। প্রথম অভিযোগ: চাঁদে বাতাস নেই, তাহলে পতাকাটা উড়ছে কেন?

ছবি দুটো লক্ষ্য করুন , পতাকা কি সত্যিই উড়ছে? (ভিডিওটি দেখুন)পতাকার একপাশ যেমন ফ্রেমের সাথে যুক্ত, ওপরের অংশও কিন্তু একটা নলের মত অ্যালুমিনিয়ামের ফ্রেম দিয়ে আটকানো। আর নিচের অংশ কুঁকড়ে আছে দেখে দূর থেকে মনে হতে পারে পতাকাটা উড়ছে যেটা আর কিছুই না শুধুমাত্র ভিজুয়াল একটা ইল্যুশন তৈরির জন্য আরোপ করা হয়েছে। আরেকটু ভাল করে দেখুন, বাজ অলড্রিন এই ছবিতে পতাকাকে স্যালুট করছেন। সেই স্যালুটকৃত অবস্থায় তাঁর ডান হাতটা মাথায় ঠেকানো, ডান হাতের দুটি আঙ্গুলও দেখতে পাবেন হেলমেটের উপরে। আর এই ছবিতে হাত নিচে নেমে এসেছে; কিন্তু দুটি ছবিতেই পতাকার উড়ন্ত অবস্থা হুবহু একই আছে। যদি পতাকা বাতাসেই উড়ত তাহলে কি কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেও সেটা হুবহু একই রকমের কোঁকড়ানো অবস্থায় থাকত?

 

আর একটা ব্যাপার ভেবে দেখুন। নাসা যদি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে এত বড় একটা নাটকই বানাবে তাহলে তারা কি এই সামান্য বাতাসের জন্য পুরো ব্যাপারটা ভন্ডুল করে দেবে? যাই হোক চলুন এবার দ্বিতীয় অভিযোগটা খতিয়ে দেখা যাক। ছবিতে কালো আকাশে কোনো তারা কেন দেখা যাচ্ছে না? (ভিডিওটি দেখুন)অনেকের বক্তব্য হচ্ছে, চাঁদে তো বায়ুমণ্ডল নেই। তাই সূর্যের আলো বায়ুমণ্ডলে বিক্ষিপ্ত হয়ে তারাগুলো অদৃশ্য করে ফেলতে পারার কথা নয়। তাহলে চাঁদের আকাশে ঝকঝকে সব তারাগুলো গেল কোথায়?  এখানে ব্যাকগ্রাউন্ডে তারা দেখা না-যাওয়ার কারণ হচ্ছে এক্সপোজার। ছবি তোলার সময় মূলত শাটার স্পিডের মাধ্যমে লেন্সের এক্সপোজার কমিয়ে বা বাড়িয়ে আলোর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। দিনের বেলায় চাঁদ এবং পৃথিবী পৃষ্ঠের তুলনায় তারাগুলোর উজ্জ্বলতা অনেক কম থাকে। এই ছবিগুলোতে যদি এক্সপোজার বাড়ানো হতো তাহলে তারাগুলো হয়তো দৃশ্যমান হতো কিন্তু সেই ক্ষেত্রে চাঁদ পৃথিবীর পৃষ্ঠ অতিরিক্ত এক্সপোজারের কারণে সাদা হয়ে যেত এবং পৃষ্ঠের অনেক বৈশিষ্ট্য ছবিতে আর এত ভালো করে পাওয়া যেত না। 


এখন এই ভিডিওটি দেখুন ( থিংক এর ভিডিওটি দেখুন), এটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে তোলা পৃথিবী পৃষ্ঠের লাইভ ভিডিও যেটা পৃথিবীকেই আবর্তন করছে। একই যুক্তি অনুসারে এখানে ব্যাকগ্রাউন্ডে তারার উপস্থিতি থাকার কথা ছিল, কিন্তু নেই। আবার এমনও নয় যে কোনো ছবিতেই তারা নেই। যেমন চন্দ্র পৃষ্ঠ থেকে পৃথিবীর এই ছবিটি ( থিংকের ভিডিওটি দেখুন) নেওয়া হয়েছিল এক্সপোজার বাড়িয়ে, তাই এখানে ঠিকই কিন্তু আবার তারা দেখা যাচ্ছে। এর পরের অভিযোগটি হচ্ছে, নভোচারীদের তো ভ্যান অ্যালেন বেল্টের মহাজাগতিক রশ্মির মধ্য দিয়ে গিয়ে বেঁচে থাকার কথা নয়।ভ্যান অ্যালেন বেল্ট হলো সৌরঝড়ের মাধ্যমে তৈরি উচ্চশক্তির আয়নিত কণিকার স্তর। চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে আমাদের পৃথিবীকে প্রধানত দুটি ভ্যান এলেন বেল্ট ঘিরে আছে। এর মধ্যে একটা হচ্ছে ভিতরের রেডিয়েশন বেল্ট, যা অত্যন্ত মারাত্মক, এবং এতে  আছে উচ্চ শক্তির প্রোটন। বাইরের বেল্টটা কিছুটা কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং এতে আছে বেটা পার্টিকেল বা নিম্নশক্তির ইলেক্ট্রন। এপোলোর নভোচারীরা ভিতরের বেল্টটা পার হয়েছিলেন মিনিটের ব্যবধানে এবং বাইরের বেল্টটা পার হতে সময় লেগেছিল দেড় ঘন্টা । 


এছাড়াও মহাশূন্যযানের গতিপথ এবং অ্যালুমিনিয়ামের খোলস এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে নভোচারীদের ওপর বিকিরণের প্রভাব কম পড়ে। ওদিকে আবার ভ্যান এ্যালেন বেল্টের আবিষ্কারক জেমস ভ্যান এলেন নিজেই নভোচারীদের উপর এই বেল্ট থেকে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়ার বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছেন। নভোচারীদের উপর ভ্যান এ্যালেন বেল্টের একটা ডোজের পরিমাণ ছিল ১০ মিলি সিভার্ট যা সমুদ্র পৃষ্ঠের লেভেলে একজন মানুষের উপর তিন বছরে পতিত বিকিরণের সমান। একজন মানুষ ২০০০ মিলি সিভার্ট বিকিরণের মুখে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে মারা যেতে পারে বলে ধারণা করা হয়। হিসেব করে দেখা গেছে সম্পূর্ণ অভিযানে একজন নভোচারীকে যে পরিমাণ বিকিরণ সহ্য করতে হয়েছে তা পারমাণবিক স্থাপনায় কর্মরত একজন কর্মীর একবছরের গ্রহণযোগ্য বিকিরণের চেয়ে বেশি কিছু নয়। 

 

এবার আসি চাঁদের পৃষ্ঠে তোলা এই ছবিটিতে যেটা দেখে ষড়যন্ত্রকারীরা আলোর উৎস নিয়ে প্রশ্ন করেন।আমরা জানি, দূরের সূর্য থেকে আসা আলোক রশ্মিগুলো সমান্তরাল এবং তাদের সমান্তরাল ছায়া তৈরি করার কথা। ষড়যন্ত্র-সমর্থকরা বলছেন, ‌এ্যাপোলোর অবতরণের জায়গায় নাকি সেটা হচ্ছে না। ইগল মুনল্যান্ডার এবং পাথরের উপর পড়া ছায়ার ভিন্ন ভিন্ন দিক দেখে মনে হয় এই ছায়াগুলি একাধিক আলোর উৎস দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে।আপনি যদি ওয়াইড এ্যাঙ্গেল ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে থাকেন, তাহলে জানেন যে ছবিতে তোলা ইমেজে,  বস্তুগুলির ধার সমান্তরাল থাকে না।  কাজেই চাঁদের পিঠে ছায়াগুলোরও সমান্তরাল থাকার কথা নয়। তাছাড়া যেই পৃষ্ঠে ছায়া পড়ছে তা যদি সমতল না হয় তাতেও ছায়ার দিক বদলে যায়।এই বিষয়টা পরীক্ষা করে দেখার জন্য সন্দেহউদ্রেককারী ছবিটির এবং চাঁদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের আদলে সেট তৈরি করা হয়েছে ওয়ার্কশপে। পাশাপাশি এতে একটি মার্কারও রাখা হয়েছে বোঝার সুবিধার জন্য। এই মার্কার এবং খেলনা মুনল্যান্ডারের ছায়া পড়েছে একই দিকে। কিন্তু মাঝের বস্তুগুলোর ছায়ার কোণ থেকে মনে হচ্ছে, এদের আলোর উৎস ভিন্ন। এই বস্তুগুলো যেহেতু চাঁদের বন্ধুর পৃষ্ঠের উপরে অবস্থিত তাই ছায়া যেভাবে পড়ার কথা সেভাবেই কিন্তু পড়েছে। চন্দ্রপৃষ্ঠের জিনিসগুলো যদি এবড়োথেবড়ো ভূমিতে না থেকে একই সমতলে থাকত তাহলে তাদের ছায়াও মোটামুটি একই দিকে তৈরি হত।


 

এখানে নভোচারি যেহেতু ছায়ার মধ্যে আছেন সেহেতু তাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখানোর কথা। কিন্তু ওয়ার্কশপের ছবিতে ছায়ার মধ্যে থাকা পুতুল নভোচারির সাদা পোশাকের উজ্জ্বলতা থেকে  পরিষ্কারভাবে দেখানো হয়েছে, আলোর উৎস থেকে চন্দ্রপৃষ্ঠে যে-পরিমাণ প্রতিফলন ঘটার কথা তা যে নভোচারীর সাদা পোশাকে যথেষ্ট উজ্জ্বলতা তৈরি করবে সেটাই স্বাভাবিক। ষড়যন্ত্রে বিশ্বাসী অনেকের আরেকটা প্রিয় প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ যদি চাঁদে প্রায় চারযুগ আগেই গিয়ে থাকতে পারে তাহলে এখন যেতে পারছে না কেন?চাঁদে অভিযান বেশ খরচসাপেক্ষ। এতে কাজ করার জন্য নাসা চার লাখ মানুষ নিয়োগ করেছিলো। চাঁদে ছয়বার অভিযানের পরে অ্যাপোলো প্রজেক্টের আওতায় আরো তিনটি অভিযান চালানোর কথা ছিলো কিন্তু মূলত খরচ বাঁচাতে সেগুলো বাতিল করে বেঁচে যাওয়া রকেট ও ফান্ড অন্যত্র কাজে লাগানো হয়। ততদিনে চাঁদে প্রয়োজনীয় অধিকাংশ গবেষণা করা হয়ে গেছে এবং চাঁদ থেকে ভবিষ্যৎ গবেষণার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ শিলার নমুনাও  সংগ্রহ করা হয়েছে এবং সেসব নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে।

এছাড়া ভেবে দেখুন না, লক্ষ লক্ষ কর্মচারী, বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, কন্ট্রাক্টর কত বছর ধরে কাজ করেছে এতে, হাজার হাজার গবেষণা পেপার বের হয়েছে, আবার ওদিকে আমাদের চোখের সামনে রকেট লঞ্চ হয়েছে, এই সবকিছু এড়িয়ে এত বড় একটা হোক্স বা ষড়যন্ত্র বানানো কি মুখের কথা? এবার চলুন তাহলে, দুটো মজার ছোট্ট তথ্য দিয়ে আজকের এই আলোচনাটা শেষ করা যাক। নাসার উপগ্রহ Lunar Reconnaissance Orbiter, Apollo 12, 14 ও 17-এর অভিযান থেকে   চাঁদে রেখে-যাওয়া লুনার মডিউল আর নভোচারীদের পদচিহ্নের ছবি তুলে পাঠিয়েছিল যা থেকে চাঁদের অভিযান নিয়ে আসলে সন্দেহের আর কোন অবকাশই থাকে না। ওদিকে আবার Apollo 11, 14 এবং 15-এর নভোচারীরা, চাঁদের বুকে প্রতিফলক আয়না রেখে এসেছিলেন। প্রতি বছর সেই প্রতিফলকে লেজার রশ্মি নিক্ষেপ করে চাঁদের দূরত্ব মাপা হয়। এবং এই পরীক্ষা থেকেই আমরা জেনেছি চাঁদ বছরে ১ ইঞ্চি করে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।


(যেহেতু এটি ভিডিওর স্ক্রিপ্ট, তাই সম্পূর্ণ ভিডিওটি দেখে স্ক্রিপ্টটি পড়ার জন্য পরামর্শ প্রদান করা হল)



সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles