কোভিড-১৯ মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকেই সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন করোনাভাইরাসের টিকা বা ভ্যাক্সিনের জন্য। অনেকেরই প্রশ্ন কেন টিকা আবিষ্কার করতে এতদিন লাগছে? তা বুঝতে হলে, বুঝতে হবে রোগ প্রতিরোধকারী এই টিকা আসলে কী? টিকা হলো নিষ্ক্রিয় জীবাণু বা জীবাণুর একটা ক্ষুদ্র অংশ যাকে ইনজেকশান বা ড্রপ হিসেবে আমাদের শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এটা রোগ প্রতিরোধের একটা সক্রিয় মহড়া বা ট্রেনিং কোর্সের মতও ভাবতে পারেন। টিকা দেওয়ার পরে একে সত্যিকারের জীবাণু মনে করে আমাদের শরীরে শুরু হয়ে যায় জীবাণু নিধন করার এক বিশাল আয়োজন।
চলুন তাহলে, ভাইরাস নিয়ে গবেষণারত মীর মুবাশ্বির খালিদের সাথে জেনে নেওয়া যাক, আমাদের দেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকেই পুঁজি করে কিভাবে কাজ করে এই টিকা। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম এক বড় সফলতা এই টিকা। এর আবিষ্কারের ফলে গত একশো বছরে কোটি কোটি মানুষের জীবন বেঁচেছে। যেমন ধরুন, গুটি বসন্তে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে শতকরা ৩০%ই নাকি মারা যেতো, ১৯১৮-এর ফ্লুর মহামারীতে ৩ থেকে ১০ কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল। আমাদের শরীরে কোটি কোটি ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া আছে যারা আমাদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করে, কিন্তু কেউ কেউ আবার ক্ষতিকরও বটে।
বিবর্তনের ধারায় আমাদের শরীরে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছে এদের প্রতিরোধ করার উপায়। কোনো ক্ষতিকর জীবাণু আমাদের শরীরে ঢোকার সাথে সাথে রক্তের সাদা রক্তকণিকারা বুঝে যায় যে এটা কোন চেনা ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়া নয়। এদের দেহের বাইরে যে প্রোটিন আর চিনি আছে তার আকার চেনা কারো সাথে তো মিলছে না। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। প্রত্যেকটা জীবাণুরই এই স্তরটা অনন্য।একেকটা সাদা রক্ত কণিকা তৈরি করতে পারে একেক ধরনের অ্যান্টিবডি বা বলতে পারেন জীবাণু-খুনি যা জীবাণুর সেই প্রোটিন বা চিনির সাথে চাবি তালার মত ফিট হয়ে গিয়ে হয় তাকে মেরে ফেলে অথবা অচল করে দেয়। বয়েসের সাথে সাথে অ্যান্টিবডির একটা বিশাল ভাণ্ডার গড়ে ওঠে। এ-কারণেই শিশুদের রোগবালাই বেশি হয়।
জীবাণু প্রবেশ করার পর তাকে চিনে নিয়ে অ্যান্টিবডি বানানো শুরু করতে বেশ ক'দিন সময় লেগে যায় আর এই সুযোগেই জীবাণুগুলো বংশবৃদ্ধি করে আমাদের অসুস্থ করে ফেলে। তবে অ্যান্টিবডির গণ-উৎপাদন একবার আরম্ভ হলেই শুরু হয়ে যায় জীবাণুর সাথে বিষম লড়াই। তো এখন টিকা দেওয়া হলে যে নিষ্ক্রিয় জীবাণু বা জীবাণুর ক্ষুদ্র অংশটা শরীরে প্রবেশ করে, তাকে ক্ষতিকর জীবাণু মনে করে আমাদের দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। আর সেই নির্দিষ্ট জীবাণুটার জন্য এক ধরনের স্মৃতিও তৈরি হয়ে যায়। কারণ আগে দেহে প্রবেশ করা কোনো জীবাণুর বিরুদ্ধে একবার অ্যান্টিবডি তৈরি হলে তাকে আমাদের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা আর সহজে আর ভোলে না। ভবিষ্যতে ওই জীবাণুতে সংক্রমিত হলে সে সাথে সাথে চেনা অ্যান্টিবডি তৈরি করে জীবাণুর বিরুদ্ধে খুব শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া দেখায়, যা টিকা না-পাওয়া ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ঘটে না।
এই টিকার ধারণাটা বেশ সরল মনে হলেও, সারা পৃথিবীর ৭ বিলিয়ন মানুষের জন্য টিকা তৈরি করতে কিন্তু খুব জটিল এবং দীর্ঘ একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। কারণ অনেক জীবাণুর ক্ষেত্রেই দেখা যায় নিষ্ক্রিয় জীবাণু বা তাদের অংশ কোন সক্রিয় প্রতিক্রিয়াই তৈরি করতে পারে না। আবার অনেক সময় এই সক্রিয় প্রতিক্রিয়া থেকে অন্যান্য অসুবিধা দেখা দিতে পারে, বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ, গর্ভবতী নারী, অসুস্থ মানুষ, জন্মগতভাবে রোগপ্রতিরোধ কম থাকা মানুষের এমনকি কখনো কখনো মৃত্যুও হতে পারে। একই সাথে জীবাণুর ঠিক কোন অংশটাকে টার্গেট করলে কাজের টিকা আসবে, সেটা কতদিন কার্যকরী থাকবে সেগুলো বের করতেও বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে। এজন্যই টিকার নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা নির্ধারণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল ট্রায়াল বা পরীক্ষার দরকার হয়:
প্রথমে সেই টিকা বিভিন্ন প্রাণীতে প্রয়োগ করে দেখা হয় এটি নিরাপদ এবং কার্যকর কিনা। সেখানে সুফল পেলে তারপর হাজার হাজার মানুষের উপর ধাপে ধাপে পরীক্ষা করা হয়, যেন কোনো ধরনের সমস্যা দেখা দিলে সাথে সাথে ট্রায়াল বন্ধ করে দেয়া যায়।এই পরীক্ষাগুলো সফল হলে প্রশ্ন আসে গণহারে উত্পাদন করে এই টিকা বাজারে আনতে কত সময় লাগবে। এবং এই সব গবেষণার বিভিন্ন ধাপের জন্য অনেক টাকার বিনিয়োগও প্রয়োজন হয়। শোনা যায়, অনেক সময়েই টিকার আবিষ্কার লাভজনক হয় না বলে বড় বড় ওষুধ তৈরির কোম্পানিগুলো টিকা তৈরিতে আগ্রহ দেখায় না। একারণে টিকা ডিজাইন থেকে শুরু করে একটি নিরাপদ টিকা বের করতে বছরের পর বছর গবেষণা ও কাজ চলে। এত বছরের গবেষণার পরও অনেকসময় নিরাপদ টিকা মিলে না। তখন বিজ্ঞানীরা নতুন কোন পথ খোঁজার চেষ্টা করেন। আজকে সারা বিশ্বের বহু সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গবেষণাগার এবং বিশ্ববিদ্যালয় মরিয়া হয়ে করোনাভাইরাসের টিকা বানানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আশার কথা হচ্ছে, এর মধ্যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মত দুই একটা গবেষণার প্রাথমিক স্তরে মানুষের ছোট দলের মধ্যে সুফল পাওয়া গেছে, এখন আরো বড় বড় দলের মধ্যে পরীক্ষা শুরু করার পরিকল্পনা চলছে। এত দ্রুতগতিতে কোন টিকা বানানোর কাজ আগে কখনো করা হয়নি। পরবর্তীধাপের এই পরীক্ষাগুলো যদি সফল হয়, তাহলে আমরা আগামী কয়েক মাসের মধ্যে, পেয়েও যেতে পারি মারণ এই করোনাভাইরাসের টিকা।