কক্ষনো একা লাগেনি এমন কেউ কি আছেন? একা কম বেশি সবারই লাগে, এটা সার্বজনীন, মানবীয় এক অনুভূতি। তবে আমরা প্রায়ই একা থাকার সাথে একাকিত্বে ভোগা বা একা লাগাকে মিলিয়ে ফেলি - এ দুটো কী এক?
একাকিত্ব সারা পৃথিবী জুড়ে আজ মহামারীর রূপ নিচ্ছে। বৃটেনের এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সের মানুষদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগই প্রায়ই একাকিত্বে ভোগেন। ২০১৮ সালে আমেরিকায় আরেক সার্ভে বলছে, ১৮ বছরের ওপরের প্রায় অর্ধেক মানুষ একাকিত্বে ভুগছেন।
শুধু পাশ্চাত্যেই নয়, বাংলাদেশ, ভারত, চীনের মত দেশগুলোতেও এই একাকিত্ব ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
আমাদের একটা ভুল ধারণা যে, বয়স বাড়লে নিঃসঙ্গতা বাড়ে। অথচ আজ তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই একাকিত্ব দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
বিবিসির ২০১৮ সালে আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়ার মহাদেশের বিভিন্ন দেশে করা জরিপে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীজুড়ে সব দেশেই তরুণ প্রজন্মের মধ্যে প্রায় ৪০% একাকিত্বে ভুগছেন। জেনারেশন Z এবং মিলেনিয়ালদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে নিঃসঙ্গতার অনুভূতি এবং সেই সাথে বিষণ্ণতা, ভিডিও গেম বা মাদকের আসক্তি।
এখানেই হয়তো আইরনিটা - আমরা এখন মানব ইতিহাসের সবচেয়ে কানেক্টেড সময়ে বাস করছি, তারপরেও এত একাকিত্ব! এর কারণ কী? আমাদের একা লাগেই বা কেন? এর কী ঐতিহাসিক বা বিবর্তনীয় ভিত্তি বা প্রয়োজন আছে? একা থাকা এবং একাকিত্বের মধ্যে পার্থক্যই বা কী?
আজকে নিউরোসাইন্সের গবেষণায় নিয়োজিত জওশান আরা শাতিলের সাথে আমরা বোঝার চেষ্টা করব এই প্রশ্নগুলোর উত্তর।
প্রথমেই দেখা যাক, একা থাকার সাথে একা লাগার পার্থক্যটা কোথায়।
খুব সোজাভাবে বলতে গেলে, একা থাকার অর্থ হচ্ছে আপনি শারীরিকভাবে একা আছেন, অন্য মানুষের থেকে দূরে। অনেকেই কম বেশি একা থাকতে পছন্দও করেন - একা যদি না লাগে তাহলে আপনি একাকিত্বে ভুগছেন না।
অন্যদিকে একাকিত্বে ভোগাটা হচ্ছে একটি মানসিক অবস্থা - যখন কেউ একা লাগার কারণে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন বা অর্থপূর্ণ, গভীর সম্পর্কের অভাব বোধ করে। বহু মানুষের ভিড়েও হয়তো আস্থা রেখে মন খুলে কথা বলার, ভরসা করার বা ভালোবাসার কাউকে খুঁজে পায়না।
কারো কারো অল্প কজন মানুষের সান্নিধ্যেই পরিপূর্ণ লাগতে পারে, আবার কেউ কেউ বহু মানুষের মাঝেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়তে পারে না, নিঃসঙ্গতায় ভোগে। কত মানুষের সংস্পর্শে আছেন, সেটা মুখ্য নয়, মুখ্য হল সম্পর্কের অর্থপূর্ণতা এবং গভীরতা।
গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘমেয়াদী একাকিত্বের এই অনুভূতির ফলে শরীরে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের পরিমাণ বেড়ে যায়। এ থেকে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্থূলতা, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, চিন্তাশক্তির হ্রাস, আলঝেইমার এমনকি উদ্বেগ বা অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার, বিষণ্ণতা বা মৃত্যুর ঝুঁকি পর্যন্ত বেড়ে যায়। একাকিত্বের নেতিবাচক প্রভাব নাকি দিনে ১৫টি সিগারেট খাওয়ার সমান।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এই একাকিত্ব কেন এতটা ক্ষতিকর?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর পিছনে দীর্ঘ বিবর্তনীয় কারণ আছে।
মানব প্রজাতির ২-৩ লাখ বছরের ইতিহাসে, বেশিরভাগ সময়টাই কেটেছে শিকারি-সংগ্রাহক হিসেবে। খাদ্য সংগ্রহ, বংশবৃদ্ধি, বন্য পশু বা অন্য শত্রু গ্রুপের হাত থেকে সুরক্ষা - সবই নির্ভর করত গোষ্ঠী হিসেব কে কত শক্তিশালী তার উপর। মানব প্রজাতি প্রাইমেটদের অংশ এবং অন্যান্য প্রাইমেটদের মতই আমাদের টিকে থাকাটাও নির্ভর করেছে শুধু মা বাবা নয়, আত্মীয় স্বজন, দলের সামাজিক বন্ধনের উপর। গোষ্ঠীবদ্ধতা মানেই ছিল টিকে থাকা, আর দলছুট হওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যু।
এই বৈশিষ্ট্যর সাথে খাপ খাইয়েই সহ-বিবর্তন ঘটেছে আমাদের মস্তিষ্ক এবং স্নায়বিক ও হরমোনাল পদ্ধতিগুলোর।
ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ব্যথা যেমন শরীরের চাহিদা পূরণের জন্য দরকারি ঠিক তেমনি মস্তিষ্কের ->এই নিঃসঙ্গতার অনুভূতিটাও গড়ে উঠেছে একটা সতর্ক করা পদ্ধতি হিসেবে - যেন একা না থেকে দলের সাথে মিশে যেতে পারি। প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলে তারাই টিকে থেকেছে যারা নিঃসঙ্গ থাকার বদলে গভীর সংযোগ, সহযোগিতা এবং পরার্থপরতা দিয়ে গোষ্ঠিকে আরও শক্তিশালী করেছে।
শুধু তাই নয়, একাকিত্ব যৌন বা বংশ বিস্তারের চাহিদা বা অর্থপূর্ণ যোগাযোগ থেকেও বঞ্চিত করে, যেটা বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত ক্ষতিকর।
বিজ্ঞানীরা ডিএনআর নামে একটি নিউরাল সার্কিটকে চিহ্নিত করেছেন যা আমাদের মস্তিষ্কের আবেগকেন্দ্র অ্যামিগডালার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ২৪ ঘন্টা একা রেখে ইঁদুরকে যখন সামাজিকতার সুযোগ দেয়া হয়, তখন তাদের ডিএনআর সার্কিট সক্রিয় হয়ে ওঠে - আমাদের সামাজিক যোগাযোগের যে ক্ষুধা দেখা যায় অ্যামিগড্যালার সাথে সম্পৃক্ত এই ডিএনআর সার্কিটই সম্ভবত তা নিয়ন্ত্রণ করে।
২০২০ সালের কোভিড-১৯ এর লকডাউনে আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি যে, একাকিত্ব শুধু ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, বরং একটা সামাজিক সমস্যা - সারা বছর ধরে চরম এই বিচ্ছিন্নতায় আমরা অস্থির হয়ে উঠেছি, পৃথিবী জুড়ে বেড়েছে ডিপ্রেশন, এংজাইটি, আত্মহত্যার প্রবণতা।
গবেষকেরা দেখিয়েছেন খাবারের মতই সামাজিক সান্নিধ্যও এক্টি জৈবিক চাহিদা। বিচ্ছিন্নতা বা নিঃসঙ্গতা মানুষের মধ্যে ক্ষিধার মতই সামাজিক সম্পর্কের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে। ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবারের ছবি দেখালে যেমন তাদের মিড-ব্রেইন পুরস্কারের আশায় সক্রিয় হয়ে ওঠে, তেমনি সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন কাউকে হাস্যোজ্জ্বল মানুষের ছবি দেখালে তাদের মিডব্রেইন একইভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। একে নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার ডোপামিন, যা কোন কিছু থেকে পুরস্কার পাওয়ার মত একটা খুশির অনুভূতি জাগিয়ে তোলে।
আমাদের এই সমাজবদ্ধ জীবনযাপন সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে গত কয়েক শতাব্দীতে। একদিকে পুঁজিবাদের বিকাশ, শিল্প বিপ্লব, প্রযুক্তির উন্নতি, নগরায়ন এবং অন্যদিকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং ব্যক্তি-অধিকারের উপর অত্যাধিক গুরুত্বের ফলে আমরা এখন্ অনেক বেশি একা বাস করি। আমরা এখন নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে বা শুধু বাবা-মা ছেলেমেয়ে নিয়ে বাস করি। খেলার মাঠ হারিয়ে গেছে, ছেলেমেয়েরা অন্যদের সাথে আড্ডা বা খেলাধুলোর চেয়ে ফ্ল্যাটে একা বসে ভিডিও গেম বা সোশ্যাল মিডিয়াতেই সময় কাটায় - মন খুলে মেলামেশা করা বা নিবিড়ভাবে আস্থার সম্পর্কগুলো আর গড়েই উঠছে না।
অনেকে বিশেষজ্ঞই দেখিয়েছেন, উনিশ শতাব্দীর আগে মানবসমাজে একাকিত্বের এরকম প্রাদুর্ভাব ছিল না।
আমরা নিন্টেন্ডো, স্মার্ট ফোন, সোশ্যাল মিডিয়ার ভার্চুয়াল সম্পর্কে আনন্দ পেলেও আমাদের মস্তিষ্ক কিন্তু এখনো রয়ে গেছে হাজার হাজার বছর আগের সেই শিকারি-সংগ্রাহক গঠনেই - কারণ বিবর্তনীয় পরিবর্তনগুলো এত তাড়াতাড়ি ঘটে না।
কম্পিউটার স্ক্রিনের অন্য পাশে থাকা মানুষটার মানসিক অস্থিরতা কেউ বুঝতে পারছেনা, সে যে স্ক্রিনের আড়ালে একলা কাঁদছে, বিষণ্ণ বোধ করছে তার যে সামাজিক সান্নিধ্য, স্পর্শ, আলিঙ্গন দরকার - তা কেউ দেখতে পাচ্ছে না। পারস্পরিক সহানুভূতি, সান্নিধ্য, বন্ধুত্ব বা প্রয়োজনে ছুটে এসে সাহায্যের হাত বাড়ানোর রীতিটা হারিয়ে যাচ্ছে। প্রিয়জনের সান্নিধ্য আমাদের দেহে অক্সিটোসিন হরমোন নিঃসরণ বাড়ায়, যা মানুষকে শান্তি দেয়, মানসিক চাপ কমায় - আধুনিক এযুগে আমরা এ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করছি বা করতে বাধ্য হচ্ছি।
ভিডিও গেম খেলে, সেলফি আপ্লোড করে বা লোকদেখানো পোস্ট দিয়ে আমাদের মাথায় ->মানুষের নিবিড় সান্নিধ্য পাওয়ার এই যে জৈবিক এবং বিবর্তনীয় প্রয়োজন তা মিটছে না - মানসিকভাবে সরে যাচ্ছি আরো দূরে, ক্রমশ আরো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছি।
কয়েক দশক আগে বিষণ্ণতা নিয়ে যেমন সামাজিক ট্যাবু ছিল আজ একাকিত্ব নিয়েও যেন সেই ধরনের ট্যাবুই কাজ করছে - এটা ভাঙা দরকার। একা লাগলে বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। এ নিয়ে যত বেশি গবেষণা হবে, কথা হবে ব্যক্তিগত, সামাজিক বা সরকারিভাবে - ততই হয়তো সমাধানের পথ বেরিয়ে আসবে।
আজ আধুনিক জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে কিভাবে আমরা এই সামাজিক এবং মানবিক প্রয়োজনগুলোও মেটাবো তা খুঁজে বের করার সময় এসেছে।
দরকার সচেতনভাবে নেতিবাচক অনুভূতিগুলোকে বাদ দিয়ে গভীর সম্পর্ক তৈরির দিকে মনোযোগ দেওয়ার, শুধু পড়ালেখা, কাজ, চাকরি ছাড়াও প্যাশনের জায়গা থেকে অর্থপূর্ণ কিছু শখ বা কাজ খুঁজে নেওয়া। সামজিকতা, সহমর্মিতা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে কম বয়েস থেকেই সচেতনতা বাড়ালে হয়তো মানুষে মানুষে দূরত্ব কমিয়ে আনা যাবে। আর এই নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব থেকে বিষণ্ণতার তৈরি হলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করাও অত্যন্ত জরুরি।
ভবিষ্যতে থিংকের আরেক এপিসোডে সাইকিয়াট্রিস্টের এর সাথে কথা বলার ইচ্ছে রইলো বিষণ্ণতা নিয়ে এবং সেই সাথে একাকিত্বের অনুভূতি কমাতে কী করা যায় তা নিয়েও।