“ই-কমার্স প্রতারণা” - আজকাল বাংলাদেশের টিভিতে, সংবাদপত্রে খুব পরিচিত একটি খবর। লক্ষ লক্ষ মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা হজম করে ফেলার এই পদ্ধতি কিন্তু নতুন নয়, আজ আসলে ইন্টারনেটের কারনে আরো ভয়ংকর হয়ে এসেছে পুরাতন এই ঠকবাজী। চলুন, জেনে নেয়া যাক কীভাবে এই প্রতারণাগুলি করা হয়, আর কীভাবেই বা চিনবেন এই সব ফ্রডদের।
আজকের ই কমার্সের ঠকবাজি এবং এর পিছনের পঞ্জি স্কিম কীভাবে কাজ করে, বুঝতে হলে আমাদের শুরু করতে হবে ১৯১৯ সালের অ্যামেরিকার বস্টন শহর থেকে। চার্লস পঞ্জি নামে এক লোক দেখলো, আন্তর্জাতিক পোস্টাল রিলে কুপন বা এক ধরনের স্ট্যাম্প যেটা যে কোন দেশে ব্যবহার করা যায়, তা বিদেশ থেকে কিনে এনে অ্যামেরিকায় বিক্রি করলে অল্প লাভ করা যাচ্ছে। কিন্তু আরো লাভের আশায় সে মানুষকে বিশাল লাভের লোভ দেখিয়ে মিথ্যা কথা বলা শুরু করল। আর হ্যাঁ, মানুষও বানের জলের মত তাকে টাকা দেয়া শুরু করল, কারন সে আসলেই কিছু মানুষকে খুব ভাল লাভ দিচ্ছিল - এক সময়ে পঞ্জির ব্যাবসায়ে সপ্তাহে ১০ লক্ষ ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ হতে শুরু করলো।
কিন্তু আসলে যদি লাভ না হয়, তাহলে পঞ্জি কীভাবে কিছু মানুষকে এত লাভ দিচ্ছিল? সেটা বুঝতে হলে আমাদেরকে এই ছবিটা দেখতে হবে।
ধরি, পঞ্জি প্রথমে দুই জন লোককে ২০% লাভ দেয়ার কথা বলে টাকা নিল। যেহেতু তার ব্যবসায়ে আসলে লাভ মাত্র ৫%, বাকি ১৫% সে কোথা থেকে পাবে?
সেটার জন্য তার নতুন চারজন শিকারের কাছ থেকে টাকা নেয়া লাগবে। তারপর সেই টাকা ব্যবসায়ে না লাগিয়ে প্রথম দুইজনকে লাভ হিসাবে দেয়া হবে।
কিন্তু এই চারজন? তাদেরকে ভূয়া লাভ দেয়ার জন্য এবার আট জন নতুন লোক লাগবে।
এভাবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দ্বিগুণ দ্বিগুণ করে শিকারের সংখ্যা বাড়তে থাকে। যেহেতু দেখতে একটা ত্রিভুজ বা পিরামিডের মত লাগে, তাই এটাকে পিরামিড স্ক্যামও বলা হয়। কিন্তু টাকা আছে, আবার বুদ্ধি কম, এমন শিকারের সংখ্যা তো অসীম না, তাই এক সময় আর নতুন শিকার পাওয়া যায় না, বিনিয়োগকারীরা আর লাভ পায় না। তখন তারা মূলধন ফেরত চাইতে শুরু করে - আর তখনই পিরামিড ভেঙ্গে পড়ে, ধরা পড়ে যায় বাটপারি।
পঞ্জির এই টেকনিক এবং ইন্টারনেটের দ্রুত খবর ছড়ানোর ক্ষমতা আর চটকদার সেলিব্রিটিদের ব্যবহার করে বাংলাদেশে আর ভারতে লোক ঠকানো হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। প্রতারণাটা ঠিক আগের ফর্মুলাতেই আগায়। কেউ একজন বিশাল লাভের প্রতিশ্রুতি দেবে - কিন্তু অপরিচিত এই মানুষকে বাকি সবাই চেনে কীভাবে? এখানেই তারা ইন্টারনেট ও গণমাধ্যমকে কাজে লাগায় ভয়ঙ্করভাবে।
লোভের টোপ ফেলার জন্য তারা ব্যবহার করে কিছু পরিচিত বা বিশ্বস্ত মুখ। সেটা হতে পারে জনপ্রিয় নায়িকা বা ক্রিকেট ক্যাপ্টেন, অথবা আর লক্ষ লক্ষ ফলোয়ার সমৃদ্ধ সোশাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার, জনপ্রিয় লেখক বা মিডিয়া পার্সোনালিটি। সাম্প্রতিককালে ১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযুক্ত এহসান গ্রুপ তাদের ব্যবসায়ের প্রসার করার জন্য ব্যবহার করেছিল ওয়াজ ও মিলাদ। এরা নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য সমাজের উচ্চপদস্থ মানুষদের সাথে ছবি তুলে সোশাল মিডিয়াতে পোস্ট করা শুরু করে। টক শো তেও তারা নিয়মত হাজির হয়, চকচকে পত্রিকার প্রচ্ছদে তাদের নাম ও ছবি আসে দেশের ভবিষ্যৎ হিসাবে।
তারপর যখন সবাই তাকে প্রায় দেবতার মত টাকার খনি ভাবে, তখন শুরু হয় খেলা।
একটা উদাহরণ দেয়া যাক। মনে করি আমাদের প্রতারকের কোম্পানির নাম হায় হায় লিমিটেড। টিভি, সংবাদপত্র, ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দিয়ে তারা সয়লাব করে ফেলবে, তারা এক লক্ষ টাকার মোটরসাইকেল ৫০ হাজার টাকায়, অথবা ১৫ হাজার টাকার ফ্রিজ পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। শুধু টাকা দেয়ার পরে জিনিস পেতে অপেক্ষা করা লাগবে ছয় মাস। প্রথম ক্রেতারা এসে গেলেই শুরু হয়ে যাবে খেলার ২য় ইনিংস।
ধরুন, মোটর সাইকেল কেনার জন্য ৫০ হাজার করে টাকা দিল ২০০ জন। আমাদের প্রতারকের পকেটে এসে গেল এক কোটি টাকা। প্রতিটা ১ লক্ষ করে মোটর সাইকেল কেনা হবে ১০টা, হাতে থাকবে ৯০ লক্ষ টাকা। এইবার পাঁচ তারকা হোটেলে, তারকাখচিত অনুষ্ঠানে মোটরসাইকেল তুলে দেয়া হবে ১০ জনের হাতে। পত্রিকায় ফটো আসবে, স্বনামধন্য ক্রিকেটার, নায়ক, নায়িকা, খ্যাতনামা মোটিভেশনাল বক্তা হাত মেলাচ্ছেন বিজয়ীদের সাথে। সেই দশজন ভাববে, ৫০ হাজার টাকা দিয়ে তারা এক লক্ষ টাকা দামের বাইক পেলো। কিন্তু টাকা তো দিয়েছিল ২০০ জন, বাকি ১৯০ জনের কী হবে? ব্যবসায়ীর পকেটে কিন্তু তখনো ৯০ লক্ষ টাকার মত লাভ। এই ৯০ লক্ষ টাকার কিছু অংশ দিয়েই ঐ প্রচারণার কাজ করা হয়েছে।
সেই টাকা দিয়ে আরো চটকদার বিজ্ঞাপন হবে, তাতে নতুন শিকার জালে ধরা পড়বে। বেকার যুবকদের বলা হবে, পঞ্চাশ হাজার দিয়ে এক লক্ষ টাকার মোটরসাইকেল কেনা যাচ্ছে, দশটার অর্ডার দাও, তারপর প্রতিটা ৮০ হাজার করে বিক্রি করলেও তিন লক্ষ টাকা লাভ হবে।
মা বাবার কষ্টের সঞ্চয় ভেঙ্গে, জমি বা সোনার গহনা বিক্রি করে তখন মানুষ বড় বড় অর্ডার দেয়। এতে ব্যাবসায়ির পকেটে আরো বড় অংকের লাভ ঢোকে, আর যা অর্ডার পায় তার ৫%এরও কম ডেলিভারি দেয়। লাভের টাকা দিয়ে তারা আরো চমক দেখায় মানুষকে, আরো বড় সেলিব্রিটিরা তাদের মুখপাত্র হয়ে জালে নতুন শিকার টানতে সাহায্য করে। এই ধরনের বাটপারদের মধ্যেই ইদানিং ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ এর মতো কোম্পানিগুলোর নাম আসছে। আবার এহসান গ্রুপ সুদবিহীন, শরীয়া ভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনার লোভ দেখিয়ে শুধু মানুষকে ঠকিয়েছে তাই না, তাদেরকেই দিয়েই আবার নতুন ভিক্টিম জোগাড় করেছে। একই ভাবে ভারতে সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের প্রায় ৪৫ হাজার কোটি রুপি আত্মসাৎ করেছিল পিএসিএল নামে এক পঞ্জি প্রতারক দল। তারাও সেই চিরচেনা ফর্মুলা ব্যবহার করেছে; মানুষকে ব্যাংকের চাইতে কয়েক গুন বেশি সুদ দেয়ার লোভ দেখিয়েছে।
যাই হোক এত যে স্ক্যামের কথা বললাম এতক্ষণ, এই স্ক্যামার বা বাটপার, এদের চিনবেন কীভাবে? সেই প্রাচীন কাল থেকে এই আধুনিক যুগ পর্যন্ত সকল বাটপারি, পঞ্জি স্কিম বা স্ক্যামিং কিন্তু একই ধারা মেনেই চলে। এই ধারাগুলো বোঝা কিন্তু তেমন কঠিন নয়! আসুন জেনে নিই সাবধান থাকার জন্য--
১। অস্বাভাবিক লাভের গ্যারান্টি দেয় এরা - অতিরিক্ত মুনাফা, বা অতিরিক্ত সস্তা পণ্যের লোভ দেখাবে। প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান যে ফ্রিজ ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে, সেখানে কেউ একটা ফ্রিজ বিজ্ঞাপনের জন্য ৫ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারে, কিন্তু শতশত ফ্রিজ বিক্রি করা সম্ভব না তার পক্ষে। এখানেই ধরে নিতে হবে যে - গড়বড় আছে।
হঠাত করে বিশাল লাভ হতে পারে, কিন্তু মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর কোন আইনসঙ্গত ব্যবসায় শতকরা ৫০% লাভ করা খুব কঠিন - প্রায় অসম্ভব। কেউ যদি সেই দাবী করে, তাহলে সাবধান!
২। জিনিস কেনা বা আমানতের ব্যবসা হলে এরা টাকা নিয়ে বহুদিন আটকে রাখবে। ব্যাংকে ছয়মাস ফিক্সড ডিপোজিট রাখলে টাকা বাড়ে। আপনার টাকা ছয় মাস আটকে রেখে যদি কেউ ফেরতও দিয়ে দেয়, তাহলেও সে প্রফিট করছে। তাই কান খোলা রাখুন, শুধু চটকদার বিজ্ঞাপনে না ভুলে, অন্যরা অভিযোগ করছে কি না, শোনার চেষ্টা করুন।
৩। এরা নিজেদের ব্যবসায়ের ব্যাখ্যা দিতে পারে না। এরা এত সস্তায় কীভাবে বিক্রি করছে, এই প্রশ্নের উত্তর যদি কেউ না দিতে পারে, তাহলে ধরে নিন, ব্যাপারটা বাটপারি।
৪। প্রচুর বিখ্যাত মানুষকে জড়ানো হয় এদের ব্যবসায়ে।
৫। নতুন গ্রাহক বা সদস্য আনার জন্য চাপ দেয় এরা
ভবিষ্যতে কোথাও বিনিয়োগ করার বা কিছু কেনার আগে খেয়াল করে দেখুন এই বিপদসংকেতগুলি পাওয়া যাচ্ছে কি না। বিনিয়োগ করার আগে নিজেকে এই কয়েকটা প্রশ্ন করুন, তাহলে প্রতারণা বুঝতে সুবিধা হবে।
আগামী আরেকটি ভিডিওতে বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে কয়েকবার ধ্বস এবং তার পিছনের কারণ নিয়ে আলোচনার ইচ্ছে রইলো।
আশা করি নিরাপদ থাকবেন, সুস্থ থাকবেন, আর মনে রাখবেন, ফ্রি টাকা আসলে কোথাওই পাওয়া যায়না - কোন কিছু যদি অবিশ্বাস্য রকম ভাল হয়, তাহলে সেটা সম্ভবত বিশ্বাসযোগ্য নয়।