মায়ানবর্ষপঞ্জি
২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর পৃথিবীর সময় ফুরিয়ে যাবে, হবে মহাপ্রলয়, জন্ম নেবে নতুন এক পৃথিবী। এমন কথা আমরা কমবেশি সবাই শুনেছি, হলিউডের সিনেমাতেও দেখেছি কীভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবী। কিন্তু পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার এমন ধারণা এলো কোথা থেকে? এর উত্তর জানতে হলে প্রথমে জানতে হবে মধ্য আমেরিকার কলম্বাস-পূর্ববর্তী মায়া সভ্যতার বর্ষগণনা পদ্ধতি সম্পর্কে।
ক্যালেন্ডার নিয়ে দেখুন থিংকের ভিডিও ক্যালেন্ডার কীভাবে এলো?
প্রাচীন প্রায় সকল সভ্যতার নিজস্ব বর্ষপঞ্জি থাকলেও মধ্য আমেরিকার মায়া সভ্যতার বর্ষগণনা পদ্ধতি সব থেকে জটিল। মায়া সভ্যতার মানুষ ছিল অত্যন্ত সুদক্ষ আকাশ পর্যবেক্ষক। তাদের এই জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিতের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে মায়া সভ্যতার মানুষ মানব ইতিহাসের অন্যতম একটি নির্ভুল বর্ষগণনা পদ্ধতি তৈরি করেছে।
মায়া সভ্যতায় ২ ধরণের বর্ষপঞ্জি দেখা যায়। একটি হল ‘জোলকিন’ (Tzolk’in), যা ২৬০ দিনের চক্র; অপরটি হল ‘হাব’ (Haab), যা ৩৬৫ দিনের চক্র। এই দুই পঞ্জি প্রতি ৫২ বছর পরপর মিলিত হয়। প্রতি ৫২ বছরের এই সময়কে বলা হয় ‘বান্ডল’ (Bundle), যা কিনা আমাদের এক শতাব্দীর সমতুল্য।
হাব চক্রে ৩৬৫ দিন আছে, যা এক সৌরবর্ষের সমান। এই হাব বর্ষে রয়েছে ১৯টি মাস। ১৮টি মাসে রয়েছে ২০ দিন করে, আর অবশিষ্ট ১ মাসে আছে মাত্র ৫ দিন। আর এই ৫ দিন বিশিষ্ট মাসকে বলা হয় ‘ওয়ায়েব’ (Uayeb)। মায়া সভ্যতার মানুষের কাছে ওয়ায়েবের এই ৫ দিন ছিল অত্যন্ত অশুভ। তাই তারা এই ৫ দিন বিভিন্ন দেবদেবীর নামে বলিদান দিত ও উপোস করত।
জোলকিন পঞ্জি আবার ২টি ছোট চক্রে বিভক্ত: ১ থেকে ১৩ সংখ্যা ও ২০টি দিনের নাম। দিনের নামকরণ তাদের বিভিন্ন দেবদেবীর নামানুসারে করা। প্রথম ৫টি দিনের নাম হলো ইমিক্স (Imix), ইক (Ik), আকবাল (Akbal), কান (Kan), ছিচ্ছান (Chicchan)। এই সংখ্যা ও নামের সংমিশ্রণে ২৬০ দিনের প্রতি দিনকে একটি অনন্য নাম দেওয়া হত। যেমন: ১ ইমিক্স (1 Imix) হলো চক্রের প্রথম দিন আর শেষ দিন হলো ১৩ আহাউ (13 Ahau)।
কিন্তু এতসব জটিল দিনের হিসাবের সাথে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার যোগসূত্র কোথায়? হাব ও জোলকিন দিনপঞ্জি প্রতি ৫২ বছর পরপর মিলিত হয়ে এক ‘বান্ডল, গণনার কথা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু তারা এই ৫২ বছরের পরের আর কোনো হিসাব দেখাতে পারতো না। ৫২ বছর পর আবার নতুন করে এই চক্র শুরু হতো। কিন্তু দীর্ঘ সময় হিসাবের জন্য তারা আরেকটি পন্থা অবলম্বন করত-দীর্ঘ গণনা পঞ্জি (Long Count Calender)। আর এই দীর্ঘ গণনা শুরু হয়েছে ৩১১৩ মতান্তরে ৩১১৪ খৃষ্টপূর্বাব্দে (১১ আগস্ট, ৩১১৪ খৃষ্টপূর্বাব্দে বেশি প্রচলিত)। মায়া সভ্যতার মানুষ দিনকে বলতো ‘কিন’ (kʼin)। আর ২০ কিন মিলে হতো এক ‘উইনাল’ (uinal)। ১৮ উইনালে ওক ‘তুন’ (Tun)। ২০ তুনে এক ‘কাতুন’ (kʼatun)। আর ২০ কাতুনে হতো এক ‘বাক্তুন’ (bʼakʼtun)। এক বাক্তুন হলো এই দীর্ঘ গণনাপঞ্জির একটি চক্র। ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত ১৩ তম বাক্তুন চলছিল। এরপরে এক নতুন বাক্তুনের সূচনা হয়েছে। এছাড়া আর কিছুই না। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহল এর অতিউৎসাহ ও অতিরঞ্জনের ফলে এই দিনকে পৃথিবীর মহাপ্রলয় হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু এটি কোনো কিছুর শেষ না, বরং নতুন এক চক্রের সূচনা!