প্রজাতির উৎপত্তিতে বিচ্ছিন্নতার শক্তি পর্ব-১
প্রজাতির DNA অনেকটা ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের মতো, ভাষা তার অবস্থান থেকে বিচ্যুত হলে শব্দের মাঝে একধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। একই ভাষা কিভাবে দুই বা দুইয়ের অধিক ভাষায় বিচ্ছিন্ন হয় সে সম্পর্কে জানতে চাইলে দেখুন ‘বিজ্ঞান পত্রিকা’য় প্রকাশিত “প্রাণিবৈচিত্র্য বনাম ভাষা বৈচিত্র্য” নামের লেখাটি। ভাষা যেমন তার অবস্থান থেকে বিচ্যুত হলে শব্দের মাঝে একধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয় তেমনই প্রাণীরাও তাদের অবস্থান থেকে বিচ্যুত হলে DNA-র মাঝে একধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়।
প্রজাতির ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা কেন ঘটে? কী কারণে পৃথকীকরণ সম্পন্ন হয়? এর প্রধান একটি কারণ ও উদাহরণ হচ্ছে সমুদ্র। ভিন্ন ভিন্ন দ্বীপের প্রজাতিরা একে অপরের সংস্পর্শে আসতে পারে না। তাই এমন পরিস্থিতিতে তাদের পরস্পরের মাঝে বিচ্ছিন্নতা তৈরির জোর সম্ভাবনা থাকে। আলাদা থাকার কারণে নতুন প্রজাতির উৎপত্তির ক্ষেত্রে দ্বীপ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হিসেবে কাজ করে।
এখানে দ্বীপের ধারণাটা একটু পরিষ্কার করা দরকার। এখানে দ্বীপ বলতে শুধু সমুদ্রের মাঝখানে চারদিকে জল দিয়ে ঘেরা এক টুকরো ভূমিকেই বোঝানো হচ্ছে না, এর পাশাপাশি অন্যান্য জিনিসকেও বোঝানো হচ্ছে। নিঃসঙ্গ মরুভূমিতে বিচ্ছিন্নভাবে একটি ব্যাঙ থাকলে ধরা যায় ঐ ব্যাঙটি দ্বীপে আছে। চারদিকে বালু দিয়ে ঘেরা, এর সাথে অন্যান্য সদস্যদের কোন যোগাযোগ নেই। মাছের ক্ষেত্রে একটি পুকুর হচ্ছে দ্বীপ। একটি পুকুরে বাস করা প্রজাতির সাথে অন্য পুকুরে বাস করা প্রজাতির কোনো যোগাযোগ নেই। একটুখানি পানি আর চারদিকে মাটি দিয়ে ঘেরা স্থান, এটাও একধরনের দ্বীপ। ভাষা ও প্রজাতির পরিবর্তনে দ্বীপই আসল জিনিস, দ্বীপের বিচ্ছিন্নতার কারণে দ্বীপবাসীরা অন্য এলাকার সদস্যদের সাথে মিশতে পারে না, ফলে আলাদা আলাদা বিচ্ছিন্ন এলাকায় আলাদা আলাদাভাবে ভাষা ও প্রাণীর পরিবর্তন হয়। প্রত্যেক এলাকাই তার নিজের সুবিধামতো স্বাধীনভাবে পরিবর্তিত বা বিবর্তিত হয়।
এরকম একটি ঘটনার কথা বলি। ৪ অক্টোবর ১৯৯৫ সালে একটি উপড়ে যাওয়া গাছ ভাসতে ভাসতে এসে হাজির হয় ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপে। গাছটির সাথে ভেসে আসে ১৫টি সবুজ ইগুয়ানা। (ইগুয়ানা হচ্ছে এক ধরনের গিরগিটি সদৃশ প্রাণী, এরা গায়ের রঙ পরিবর্তন করতে পারে। যখন যে পরিবেশে যে রঙ থাকে সে পরিবেশ অনুসারে গায়ের রঙ পরিবর্তন করার চমৎকার দক্ষতা আছে।)
এর কিছুদিন আগে ঐ এলাকার আশেপাশে দুটি প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল। ধারণা করা হয় ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ১৬০ মাইল দূরের আরেক দ্বীপ গুয়াডেলুপ থেকে তারা ভেসে ভেসে এখানে এসেছিল। এই প্রজাতির ইগুয়ানাগুলো গাছে চড়তে পছন্দ করে। হয়তো গাছে থাকা অবস্থায় ঘূর্ণিঝড়ের ঝাপটায় গাছ উপড়ে গিয়েছিল এবং গাছ ছেড়ে ঐ মুহূর্তে অন্য কোথাও যাবার উপায় ছিল না। শেষমেশ জীবিত অবস্থায় ১৫ জন এসে পৌঁছায় ক্যারিবীয় দ্বীপে। এই দ্বীপে আবার আগে থেকে কোনো ইগুয়ানা ছিল না। একদমই নতুন পরিবেশ। পরিবেশ নতুন হলেও তারা তাদের সনাতন জীবন যাপন ছেড়ে ঐ দ্বীপের সাথে মানানসই হয়ে নিজেদের মাঝে বংশবিস্তার শুরু করেছিল।
তারা যে এখানে এসেছিল এই ব্যাপারটা আমরা জানি কারণ স্থানীয় মাছ শিকারিরা এদেরকে দেখেছিল। কেউ যদি না দেখতো তাহলে জানা হতো না ১৯৯৫ সালে এরা এখানে ভেসে এসেছিল। ওরা যেখান থেকে এসেছে সেখানেও হয়তো এমনটাই ঘটেছিল। কয়েক শতাব্দী আগের কোনো এক সময়ে কোনো একভাবে গুয়াডেলুপ দ্বীপে এসে পৌঁছেছিল ইগুয়ানার কিছু সদস্য। এদের পৌঁছার দৃশ্য হয়তো তখন কেউ দেখেনি। এই লেখাটির/এই অধ্যায়ের পরবর্তী অংশে এই বিষয়টা নিয়েই আলোচনা করবো। তবে তার জন্য আমরা বেছে নিব অন্য একটি দ্বীপকে, এটি ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ। দ্বীপটির নাম গ্যালাপাগোস। এই দ্বীপের প্রাণবৈচিত্র্যই চার্লস ডারউইনকে বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে ভাবতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।
[১৮৩৫ সাল। তখন ব্রিটিশদের প্রচণ্ড প্রতাপ। গড়ে নিয়েছে উপনিবেশ, শাসন করে বেড়াচ্ছে সারা দুনিয়া। তখন উড়োজাহাজের তেমন উন্নতি হয়নি। জলের জাহাজই ভরসা। ঐ সময়ে পৃথিবীটা গুগল ম্যাপের মতো হাতের মুঠোয় চলে আসেনি। বিভিন্ন দেশে স্বল্প সময়ে যাতায়তের জন্য সংক্ষিপ্ত পথ আবিষ্কারের জন্য লাগানো হলো এক জাহাজকে। বিখ্যাত সেই জাহাজের নাম বিগল। ঘটনাক্রমে জাহাজে নিয়োগ দেয়া হলো একজন প্রকৃতিপ্রেমিককে। প্রকৃতিপ্রেমিক আবার ক্লাসের লেখাপড়া ফেলে সারাদিন প্রকৃতি নিয়েই পড়ে থাকতেন। তিনি হলেন বিখ্যাত চার্লস রবার্ট ডারউইন। এই জাহাজ ভ্রমণেই তিনি আবিষ্কার করেছিলেন প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব। গ্যালাপাগোস নামের একটি দ্বীপপুঞ্জের প্রাণবৈচিত্র্য দেখে প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের ধারণার উপর জোর সমর্থন পান। প্রাণবৈচিত্র্যের পাশাপাশি এই দ্বীপটি তাই ঐতিহাসিকভাবেও বিখ্যাত।]
গ্যালাপাগোস আসলে অনেকগুলো দ্বীপের সমাহার। সবগুলোকে একত্রে বলা হয় ‘গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ’। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ৫০০ মাইল দূরে বিষুবরেখার কাছাকাছি প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে এদের অবস্থান। এরা আসলে আগ্নেয়গিরিজাত দ্বীপ। সমুদ্রতলের আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত তথা লাভা উদ্গীরণের ফলে এই দ্বীপপুঞ্জের সৃষ্টি হয়েছিল। পৃথিবীর বয়সের সাথে তুলনা করলে এই দ্বীপের বয়স খুব একটা বেশিও না। মাত্র কয়েক মিলিয়ন বছর মাত্র। অর্থাৎ একসময় এই দ্বীপের সমস্তটাই জলের নিচে ছিল। সমুদ্রতল থেকে আগ্নেয়গিরির চাপে ধীরে ধীরে ভূমি উপরে ভেসে উঠেছে। তার মানে এখন যদি এই দ্বীপে প্রাণের অস্তিত্ব থাকে তাহলে ঐ প্রাণ বাইরে থেকে কোনো না কোনো একভাবে এখানে এসেছিল। সম্ভবত দক্ষিণ আমেরিকার মূল ভূখণ্ড থেকে কোনো এক দুর্ঘটনায় এখানে এসে পৌঁছেছিল প্রাণী ও উদ্ভিদের বীজ। অনেক দূরের মূল ভূখণ্ড থেকে দ্বীপপুঞ্জের কোনো একটা দ্বীপে প্রাণী বা উদ্ভিদ এসে পৌঁছে গেলে বাকি দ্বীপগুলোতে ছড়িয়ে পড়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। কারণ এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়।
গ্যালাপাগোসেও অনেক ইগুয়ানা আছে। কেউই জানে না প্রথম ইগুয়ানাটি কখন এই দ্বীপে আরোহণ করেছিল। ১৯৯৫ সালের এঙ্গোলা দ্বীপের ইগুয়ানার মতো তারাও হয়তো মূল ভূখণ্ড থেকে ভেসে ভেসে এসে পৌঁছেছিল। এখনকার সময়ে মূল ভূখণ্ড থেকে সবচেয়ে কাছের দ্বীপটি হলো ‘স্যান ক্রিস্টোবাল’। স্যান ক্রিস্টবালে আজকের দিনে আমরা একটি মাত্র দ্বীপ দেখতে পাই, কিন্তু লক্ষ লক্ষ বছর আগে আরো কতগুলো দ্বীপের অস্তিত্ব ছিল, এরা এখন পানির নিচে নিমগ্ন। সময়ের সাথে সাথে পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়াতে এরা ধীরে ধীরে পানির নিচে নিমগ্ন হয়ে যায়।
মূল ভূখণ্ড থেকে কিছু ইগুয়ানা এসে পৌঁছানোর পর সেখানে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা তথা প্রচুর পরিমাণে জন্ম লাভ করে বিস্তৃত হবার অফুরন্ত সুযোগ আছে। এখানকার পরিবেশ মূল ভূখণ্ড থেকে একদমই আলাদা। আগ্নেয়গিরির অনুর্বর এলাকা দক্ষিণ আমেরিকা থেকে একদমই ভিন্ন। তারা নতুন পরিবেশের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পেরেছিল।
অন্যদিকে এক দ্বীপের সাথে আরেক দ্বীপের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। তাই কোনো এক দ্বীপে আশ্রয় পাওয়া ইগুয়ানা নানা প্রাকৃতিক কারণে সহজেই অন্য দ্বীপে পৌঁছে যেতে পারবে। মূল ভূখণ্ড থেকে কোনো দুর্ঘটনায় এখানে প্রাণী এসে পৌঁছার সম্ভাবনা হয়তো লক্ষ লক্ষ বছরে একবার, কিন্তু সেই তুলনায় কয়েক শত বছরের মাঝেই এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে যাবার সম্ভাবনা বাস্তব।
দ্বীপগুলোর পরিবেশ আবার একটির তুলনায় আরেকটি ভিন্ন। ভিন্ন ভিন্ন হবার কারণে এবং যোগাযোগ না থাকার কারণে দূরত্ব কম হলেও পরিবেশ অনুসারে তারা ভিন্ন ভিন্নভাবে বিবর্তিত হয়েছে। যেমনটা আমরা আগে দেখেছিলাম ভাষার ক্ষেত্রে। ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশের সাথে নিজেদের উপযুক্তভাবে মানিয়ে নেবার জন্য অর্থাৎ আরোপিত প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য তারা ভিন্ন ভিন্নভাবে নিজেদেরকে পরিবর্তন করে নিয়েছে। ধীরে ধীরে এই পরিবর্তন এত বেশি হয়ে গেছে যে ভিন্ন দ্বীপের সদস্যরা মিলে যৌন প্রজননে অংশগ্রহণ করলে কোনো সন্তান উৎপাদিত হয় না। পরস্পর মিলে সন্তান উৎপাদন করতে না পারার অর্থ হচ্ছে এরা পরস্পর ভিন্ন প্রজাতি। অথচ এরা একই পূর্বপুরুষ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছিল।
এর ফলাফল হিসেবে আজকে আমরা দেখতে পাই গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে ল্যান্ড ইগুয়ানা (Land iguana)-র তিনটি প্রজাতি আছে। এদের কেউই কারো সাথে মিলে সন্তান উৎপাদনে সক্ষম নয়। উল্লেখ্য সারা পৃথিবীতে শুধুমাত্র গ্যালাপাগোসেই ল্যান্ড ইগুয়ানা পাওয়া যায়। ল্যান্ড ইগুয়ানা পরিবারের প্রজাতি কনোলোফাস পেলিডাস (Conolophus pellidus) পাওয়া যায় শুধুমাত্র সান্টা ফে দ্বীপে। কনোলোফাস সাবক্রিসটাটাস (Conolophus subcristatus) বেশ কয়েকটি দ্বীপে বাস করে। এর মধ্যে ফার্নান্দিনা, ইসাবেলা ও সান্টা ক্রুজ অন্যতম। ধারণা করা হয় এই দ্বীপগুলোতে কনোলোফাস সাবক্রিসটাটাস বিভক্ত হয়ে কয়েকটি ভিন্ন প্রজাতি তৈরি হবার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একসময় হয়তো এদের মাঝেও প্রজাতিগত ভিন্নতা দেখা দিবে। তৃতীয় প্রকার ল্যান্ড ইগুয়ানা কনোলোফাস মার্থি (Conolophus marthae) পাওয়া যায় একদম উত্তরের দিকের ইসাবেলা দ্বীপে। এই দ্বীপ পাঁচটি আগ্নেয়গিরির একটি সারি নিয়ে গঠিত। এই দ্বীপটি আকারে অন্য দ্বীপের তুলনায় কিছুটা বড়।
এই দ্বীপটি আরো একটি আগ্রহোদ্দীপক বিষয় সম্পর্কে ইঙ্গিত করে। সমুদ্রে যদি পানির স্তর উপরে উঠে যায় তাহলে ইসাবেলার নিচু ভূমির সম্পূর্ণটা ডুবে যাবে। অর্থাৎ এখানে পাঁচটি আগ্নেয়গিরিকে ঘিরে পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন দ্বীপের সৃষ্টি হবে। ফলে তৈরি হবে পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ। পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশের প্রভাবে একই প্রাণী বিশ্লিষ্ট হতে পারে পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতিতে। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হচ্ছে প্রজাতির উৎপত্তির জন্য আলাদা জলবায়ুর দরকার নেই। একই জলবায়ুর এলাকায় থেকেও শুধুমাত্র আলাদাভাবে অবস্থানের কারণে প্রাণীর মাঝে প্রজাতিগত ভিন্নতা আসতে পারে। এখানে যে প্রক্রিয়ায় পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হচ্ছে ঠিক একই প্রক্রিয়ায় পৃথিবীতে রাজত্ব করে বেড়ানো বৈচিত্র্যময় প্রজাতির সবগুলোরই উৎপত্তি হয়েছিল।
কিছু দিক থেকে গ্যালাপাগোস দ্বীপের পরিবেশ একদমই ব্যতিক্রমী। এই দ্বীপ প্রাণবৈচিত্র্যে এমন কিছু প্রজাতি উপহার দিয়েছে, যা দ্বীপের পরিবেশতাত্ত্বিক গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলেছে। দ্বীপপুঞ্জের কোনো একটি দ্বীপের পরিবেশ ল্যান্ড ইগুয়ানার স্বভাব চরিত্র একদমই বদলে দিয়েছিল। পরিবেশগত কারণে হয়তো তারা একসময় অগভীর সমুদ্রতলের শৈবাল খেতে শিখেছিল। ডুব দিয়ে দিয়ে শৈবাল সংগ্রহ করতো। ডুব দেবার দক্ষতা তাদেরকে প্রকৃতিতে টিকে থাকতে বাড়তি উপযোগ প্রদান করেছিল। এদের থেকেই স্থায়ী পরিবর্তনের মাধ্যমে উৎপত্তি ঘটেছে জলজ ইগুয়ানা বা Marine iguana-র। জলজ ইগুয়ানাও গ্যালাপাগোস ব্যতীত পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।
তাদের এমন কতগুলো ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য আছে যা তাদেরকে অন্য প্রজাতি থেকে একদমই সারিতে ফেলে দিয়েছে। একদিন হয়তো এমন দৃশ্য দেখা যাবে যেখানে জলজ ইগুয়ানারাই একাধিক প্রজাতিতে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে এবং জলজ ইগুয়ানার নতুন গণ (Genus) তৈরি হয়েছে।
গ্যালাপাগোসের অন্যান্য প্রজাতির বেলাতেও একই গল্প প্রযোজ্য। যে কারণে ইগুয়ানার বৈচিত্র্য তৈরি হয়েছে একই কারণে বৃহৎ কচ্ছপ, লাভা লিজার্ড, মকিং বার্ড, ফিঞ্জ সহ অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রজাতিগত বৈচিত্র্য তৈরি হয়েছে গ্যালাপাগোস দ্বীপে।
একই ধরনের প্রক্রিয়া ঘটেছে সমগ্র বিশ্বে, সমস্ত বিশ্বের প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতে। গ্যালাপাগোস হচ্ছে ছোট একটা এলাকার ছোট একটা উদাহরণ মাত্র। গ্যালাপাগোসের মতো অন্যান্য কত এলাকায় এমন বিচিত্র ঘটনা ঘটে চলছে তার কোনো হিসাব নেই। শুধু বিচ্ছিন্ন দ্বীপই নয়, খাল-বিল-নদী-পাহাড়-মরুভূমির কারণেও নতুন নতুন প্রজাতির উৎপত্তি হয়। প্রশস্ত ও বহমান একটি নদীও প্রজাতিকরণে ভূমিকা রাখতে পারে। নদীর দুই পাশের জলবায়ু ও এলাকা এক হলেও তাদের এক পারের সদস্যরা আরেক পারে যাওয়া খুব কষ্টকর ব্যাপার (বুদ্ধিমান মানুষের কথা বাদ দিলাম)। বিচ্ছিন্ন হবার কারণে এক পারের সদস্যদের তুলনায় অন্য পারের সদস্যদের মাঝে কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়। অনেকটা ভাষার মতো। যেমন করে বিচ্ছিন্নতার কারণে একটি ভাষা থেকে একটি উপভাষার সৃষ্টি হয়, একসময় উপভাষা যেমন ভিন্ন একটি ভাষায় পরিণত হয় তেমনই আরো পরিবর্তনের মাধ্যমে নদীর দুই পারও পরস্পর ভিন্ন প্রজাতির এলাকায় পরিণত হয়। কোনো একভাবে এদেরকে একত্র করলে দেখা যাবে এদের দিয়ে আর সন্তান উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। অর্থাৎ তারা প্রজাতিগতভাবে ভিন্ন হয়ে গেছে। যদিও তাদের উভয়ের পূর্বপুরুষ একসময় একই প্রজাতির সদস্য ছিল।
বিস্তৃত পর্বতমালাও নদীর মতো বিচ্ছিন্নকরণে ভূমিকা রাখতে পারে। বিশাল এলাকাব্যাপী ধু ধু মরুভূমিও এই ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশের ইঁদুর এবং কানাডার ইঁদুর দেখতে হয়তো এক কিন্তু তারা যদি পরিবর্তিত হয় তাহলে নিশ্চয়ই নিজ নিজ পরিবেশ অনুসারে পরিবর্তিত হবে। এক অঞ্চলের বিবর্তনের ধারা আরেক অঞ্চলের বিবর্তনের ধারা থেকে ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক।