টিকা নিলে কি আমাদের শরীরের ক্ষতি হতে পারে?
একটি জরুরি বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য হাজির হলাম। সম্প্রতি একজন সুপ্রতিষ্ঠিত ডাক্তার কোভিডের টিকা নিতে নিরুৎসাহিত করেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। এটি নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।
টিকার কি কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে? টিকা নিলে কি আমাদের শরীরের ক্ষতি হতে পারে? হ্যাঁ, টিকার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে। কিন্তু কতটা, আসুন দেখা যাক।
প্রতিটি মানুষের শরীরে একটি রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা আছে। এটি সরল কিছু নয় বরং শতকোটি কোষের বিশাল এক সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীতে যেমন নানা স্তরের প্রতিরোধ বাহিনী, নানা প্রকার অস্ত্র-সরঞ্জামের ব্যবহার রয়েছে আমাদের শরীরেও তাই। প্রতিনিয়ত ঝাঁকে ঝাঁকে জীবাণু আমাদের আক্রমণ করছে। কোষীয় প্রতিরক্ষাবাহিনীর বদৌলতে এটা আমরা উপলব্ধি না করলেও মানুষ মরে গেলে তা বোঝা যায় কারণ মৃত্যুর কয়েকঘন্টা মধ্যেই শরীরে পচন শুরু হয়, যা জীবাণু আক্রমণের কারণেই ঘটে।
কিন্তু রোগ ঠেকানোর প্রক্রিয়াটি খুব সহজ নয় এবং সময় সাপেক্ষও বটে। দীর্ঘ সময় (যেমন কয়েকদিন) আর প্রচুর ‘প্রাণের’ বিনিময়ে শরীরের রোগ প্রতিরোগ ব্যবস্থা একটি যুদ্ধে জয় লাভ করে। তাছাড়া জীবাণুরা বারবার ফিরে আসে আর শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা একই যুদ্ধ বারবার করতে আগ্রহী নয়। তাই কোনো একটি জীবাণু আক্রমণ করলে শরীর তাকে চিনে রাখে এবং তার বিরুদ্ধে মোক্ষম অস্ত্র আগে থেকেই প্রস্তুত করে রাখে যেন অনায়াসে ঘায়েল করতে পারে। যদি একটি জীবাণু খুব বিপদজনক হয় তাহলে আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা সেই রোগের ‘স্মৃতি কোষ’ তৈরি করে রাখে এবং বছরের পর বছর সুপ্ত অবস্থায় থাকে। যখন কোনো একটি জীবাণু দ্বিতীয়বারের মতো আক্রমণ করে বসে তখন সেই স্মৃতি কোষ সক্রিয় হয় এবং আগের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী আক্রমণ সাজিয়ে সহজেই এন্টিবডি তৈরির মাধ্যমে সেই জীবাণুকে পরাস্থ করে। এই কারণে ভাইরাসজনিত অধিকাংশ রোগই একবার হয়ে গেলে দ্বিতীয়বার আর হয় না। এই কারণেই ছোট শিশুদের মধ্যে ভাইরাসজনিত সাধারণ রোগ-ব্যাধি লেগেই থাকে। কারণ তাদের শরীরে বিভিন্ন রোগের জন্য স্মৃতি কোষ তখনো তৈরি হয়নি।
টিকা যখন দেওয়া হয় তখন ঠিক এই কাজটিই করা হয়। শরীরে একটি রোগের স্মৃতিকোষ তৈরি করে দেওযা হয় যেই রোগটি তখনো হয়নি। এরফলে যখন সত্যিকারের রোগটি আক্রমণ করে তখন শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা সহজেই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ সাজাতে পারে। কেমন করে টিকার মাধ্যমে এই কাজটি করা হয়? সেই রোগের জীবাণুটি শরীরে ঢুকিয়ে! কিন্তু তাহলে তো টিকা দেওয়ার কারণেই আমাদের শরীরে সেই রোগটি হয়ে যাওয়ার কথা, তাই না? আসলে জীবাণুটি আমাদের শরীরে ঢোকানো হয় ঠিকই তবে রোগ সৃষ্টির উপযোগী অবস্থায় নয়। যেমন: জীবাণুটিকে শরীরে প্রবেশের পূর্বে তাকে অকার্যকর করে দেওয়া হয়, কিংবা বিদীর্ণ করে দেওয়া হয় যেন তা শরীরে রোগ তৈরি করতে না পারে কিন্তু আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য চিনে রেখে সেই অনুযায়ী স্মৃতিকোষ তৈরি করতে পারে। অনেক সময় এই রকম অকার্যকর ভাইরাসের মাধ্যমে শরীরে যথেষ্ট কার্যক্ষম স্মৃতিকোষ তৈরি হয় না তাই আরেকটু কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। সেইক্ষেত্রে জীবন্ত ভাইরাসটিকেই টিকা হিসেবে ব্যবহার করতে হয়। এদের বলা হয় Live vaccine বা জীবন্ত টিকা। কিন্তু এতে কি জীবাণুটির জয়ী হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না? এই সম্ভাবনা এড়ানোর জন্য গবেষণাগারে জীবাণুটিকে বদলে দেওয়া হয়। রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুটির বদলে এর দুর্বল একটি প্রকরণ তৈরি করে সেটিকে টিকা হিসেবে শরীরে দেওয়া হয় যা আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে যথেষ্ট কার্যকর ব্যবস্থা নিতে উদ্বুদ্ধ করে কিন্তু জীবাণুটি শরীরের বিশেষ কিছু ক্ষতি করতে পারে না।
কিছু কিছু ভাইরাস প্রাকৃতিকভাবে খুব দ্রুত বদলে যায় তাই আগের স্মৃতি কোষ এদের নতুন প্রকরণের বিরুদ্ধে অনেক সময় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে না। যেমন: ইনফ্লুয়েঞ্জা তথা ফ্লু ভাইরাস। এই জন্য প্রতিবছরই এই ভাইরাসের নতুন টিকা বের হয়। তবে অধিকাংশ টিকাই দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সুরক্ষা দেয়, এমনকি আজীবন ধরেও সুরক্ষা দিতে পারে। ছোট শিশুদের যেসব টিকা দেওয়া হয় সেগুলা সারাজীবনই কাজ করে।
তবে সবকিছুরই যেমন নেতিবাচক দিক আছে, টিকারও আছে। কিন্তু কতটা? সেটা কী যে রোগের বিরুদ্ধে সেই টিকাটি দেওয়া হয়েছে শরীরে তার প্রভাবের চেয়ে বেশী? এই বিষয়টি তুলনা করা একটু কঠিন। হামের টিকার কথাই ধরা যাক। ২০১৮ সালে ইউরোপে কোটি কোটি শিশুকে হামের টিকা দেওয়া হয়েছে যদিও মাত্র ৮৩ হাজার শিশু হামে আক্রান্ত হয়েছে। এই ক্ষেত্রে যদি সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা দেয় টিকার তাহলে কোটি কোটি শিশুর ক্ষেত্রে সেই সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সার্বিক ভাবে অনেক প্রকটই মনে হয় না কি? সেই তুলনায় আক্রান্ত শিশুর পরিমানতো অনেক কম।
কিন্তু টিকা না দিলে কী হতো দেখা যাক। ১৯৬৩ সালে যখন হামের টিকা প্রচলিত হয় তার আগে কার্যত পৃথিবীর প্রতিটি শিশু হামে আক্রান্ত হতো। যেমন: ১৯৫০ এর দশকে ১৩.৫ কোটি শিশু হামে আক্রান্ত হয় যদিও সেই সময় পৃথিবীর জনসংখ্যা বর্তমানের তুলনায় অনেক কম ছিল। এই হারে যদি বর্তমানে শিশুরা হামে আক্রান্ত হত তাহলে টিকার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার তুলনায় সেই প্রভাব কতটা হতো? একটু হিসেব করা যাক।
ধরি হামের টিকাবিহীন একটি পৃথিবীতে ১০ কোটি শিশু হামে আক্রান্ত হলো।
এদের মধ্যে ৯ কোটি ৮০ লাখ শিশু (৯৮ শতাংশ) তীব্র জ্বরে ভুগবে এবং অস্বস্তিকর গুটি হবে শরীরে।
৮০ লাখ শিশু (৮ শতাংশ) বিপদজনক ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হবে।
৭০ লাশ শিশু কানের প্রদাহে ভুগবে যাদের অনেকেই স্থায়ী ভাবে শ্রবণশক্তি হারাবে।
৬০ লাখ বা ৬ শতাংশ শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হবে যেটি হামের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব। এটি এককভাবে সেই ১০ কোটি শিশুর মধ্যে ১২ লাখ শিশুর মৃত্যুর কারণ হবে।
১০ হাজার শিশুর এনসেফালাইটিস হবে।
২৫০০ শিশুর SSPE (subacute sclerosing panencephalitis) হবে, যে রোগে হামের ভাইরাসটি মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে অবস্থান করে এবং কয়েক বছরের মধ্যে মৃত্যু ঘটায়।
সার্বিকভাবে অন্তত আড়াই কোটি শিশু স্থায়ী ক্ষতির শিকার হবে।
সবশেষে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর তথ্যটিঃ ২০ লাখ শিশুর হামের কারণে মৃত্যু হবে।
এখানেই বিষয়টি শেষ হয়ে যাবে তা নয়। হাম মোকাবেলা করে সেরে উঠবে যেসব শিশু তাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে যা ঠিক হতে সময় লাগবে দীর্ঘদিন। এই সময়ের মধ্যে এরা অন্যান্য রোগে ভোগের সম্ভাবনা অনেক বেশী থাকবে। যার একেবারেই তেমন কিছু হবে না তারও দুই সপ্তাহ সময় (হাম সেরে ওঠা পর্যন্ত) খুব কষ্টের মধ্য দিয়ে কাটবে।
অপর দিকে টিকা নেওয়ার ফলে কী ঘটবে দেখা যাক।
যদি পূর্বোক্ত ১০ কোটি শিশুকে টিকা দেওয়া হয় তাহলে,
এদের ১০ শতাংশ বা ১ কোটির হালকা জ্বর হবে।
৫০ লাখ বা ৫ শতাংশ শিশুর মৃদু গুটি দেখা যেতে পারে।
১০ হাজার বা ০.০০১ শতাংশ শিশুর তীব্র এলার্জিজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে যার জন্য চিকিৎসা নিতে হবে।
১ হাজার বা ০.০০০১ শতাংশ শিশুর প্রজননতন্ত্রের প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে।
এবং ১ হাজার জনের সবচেয়ে মারাত্বক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এনসেফালাইটিস হতে পারে।
কাজেই দেখা যাচ্ছে দশ কোটি শিশুর মধ্যে মাত্র ১২০০০ জনের মধ্যে কিছু মারাত্বক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যাবে যার প্রায় সবই উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময়যোগ্য।
টিকা নিলে শিশুর অটিজম দেখা দেয় বলে যে একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে সেটিও আরো অসংখ্য ফলো-আপ গবেষণার মাধ্যমে বাতিল করা হয়েছে এবং ভিত্তিহীন বলে প্রমাণীত হয়েছে।
উপরের তথ্যগুলোর মধ্যে একটু তুলনা করে দেখুন আপনার শিশুর হাম হলে যে প্রভাব হবে তার তুলনায় টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অতি অতি নগন্য। তাছড়া টিকা নেওয়ার ফলে কারো মৃত্যু হয়েছে এমন খবর অতি অতি বিরল। কিন্তু হাম হওয়ার ফলে শিশুর মৃত্যুর প্রমানীত ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে ভুরি ভুরি। কেবল ২০১৭ সালেই হামের কারণে সমগ্র পৃথিবীতে ১ লাখ ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। তাত্বিক ভাবে এই লেখাটি যতক্ষণে পড়ে শেষ করছেন ততক্ষণেই হাজারখানেক শিশু হামের কারণে মৃত্যুবরণ করবে।
টিকাকে আপনি গাড়ির সিটবেল্টের সাথে তুলনা করতে পারেন। গাড়ির সিটবেল্টও খুব বিরল কিছু পরিস্থিতিতে দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে তাই বলে আপনি কি মনে করেন সিটবেল্ট পরে গাড়ি চালনো সিটবেল্ট না পরে গাড়ি চালানোর চেয়ে বেশী ঝুঁকিপূর্ণ?
কিন্তু যদি সত্যিই আপনার শিশুর টিকার প্রতি চরম এলার্জি থাকে বা টিকার প্রতি চরম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে তাহলে আপনি কী করবেন? আপনি কি টিকার বিরুদ্ধে প্রচারনা চালাবেন? সত্যি বলতে আপনার ভূমিকা সেই ক্ষেত্রে হবে সম্পূর্ণ বিপরীত। আপনাকেই হতে হবে টিকার সবচেয়ে বড় প্রচারক। কেননা যেহেতু আপনার শিশু টিকা নিতে পারছে না সেই ক্ষেত্রে আপনার নিশ্চিত করতে হবে যেন আপনার শিশুর চারপাশের সবাই খুব ভালোভাবে টিকা পায়, তাতেই কেবল ছোঁয়াচে রোগটি আপনার শিশুর শরীর পর্যন্ত এসে পৌঁছাতে পারবে না। একটি সমাজে যদি অধিকাংশ মানুষে কোনো রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ থাকে তাহলে যাদের প্রতিরোধ নেই তারাও সেই রোগ হতে মুক্তি পায়ে কেননা অধিকাংশেরই রোগটি হয় না বলে তা একের শরীর হতে অপরের শরীরে পৌঁছাতে পারে না। এই ব্যাবস্থাটিকে বলে Herd immunity বা গণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। এর ফলে আপনার যে শিশুটি টিকা নিতে পারছে না সে-ও টিকার সুফল পাবে পুরো মাত্রায়। তবে কেবল হামের ক্ষেত্রে যদি গণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হতে হয় তাহলে অন্ততঃ ৯৫ শতাংশ শিশুর হামের টিকা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। পোলিও বা অন্যান্য টিকার ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। ভেবে দেখুন সারা দেশ যদি পোলিওর টিকা নিয়ে পোলিও মুক্ত হয়ে যায় তাহলে আপনার শিশুটি টিকা না নিলেও পোলিও মুক্ত হবে না কি?
উপরে যে তথ্যগুলো দেওয়া হলো সেগুলো টিকা সম্পর্কিত অনেক স্থুল তথ্য যা সাধারণ মানুষের বোধগম্য। একজন চিকিৎসকের বোধগম্যতা নিশ্চয়ই আরো অনেক বেশী হওয়ার কথা। তারপরেও সমাজে প্রতিষ্ঠিত হাতে গোনা দুই একজন চিকিৎসক যারা টিকার বিরুদ্ধে কথা বলে তারা নিশ্চিৎভাবেই অসততা থেকে বলে কিংবা তাদের ব্যক্তিগত কোনো অসদুদ্দেশ্য চারিতার্থ করার জন্যই বলে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো আইন আছে কিনা জানিনা তবে ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে আসুন এদের বয়কট করি।
[তথ্য ইউটিউবের kurzgesagt চ্যানেল অবলম্বনে]
[মূল লেখা বিজ্ঞান পত্রিকা থেকে]