জীবাশ্ম বা ফসিলের বয়স নির্ধারণ হয় কীভাবে?
আমরা মাঝে মাঝেই শুনে থাকি-আমাদের পৃথিবীর বয়স ৪.৬ বিলিয়ন বছর। পৃথিবীতে ৯ কোটি বছর আগে যেসব ডাইনোসর ছিলো তাদের বিশাল মাথা এবং ধারালো দাঁত শিকারের কাজে ব্যবহার হতো। প্যারাডক্সিডেস আর্থ্রোপোডা নামের এই প্রাণীকে ক্যামব্রিয়ান যুগে পাওয়া গিয়েছে ৫০০ থেকে ৫০৯ মিলিয়ন বছর আগে। বিবর্তন নিয়ে দেখুন থিংকের ভিডিও মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস
এই যে উপরে ব্যবহার করা বাক্য গুলোর মাঝে যেটি সব বাক্যেই আছে তা হলো সংখ্যাভিত্তিক অংশটা। এই সংখ্যাভিত্তিক অংশটা আসলে বোঝায় এদের বয়স। আমরা না হয় যখন জন্মগ্রহণ করি তখন পিতামাতা কাছে থাকে, সেই সাথে নিজের জন্মদিবস এবং বছরটাও মনে থাকে তাঁদের। পরে বয়স জানাটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায় না। কিন্তু পৃথিবী, ডাইনোসোর, প্যারাডক্সিডেস এগুলোর সময়ে তো মানুষের আনাগানোই ছিলো না। তাহলে তাদের বয়স কীভাবে জানা গেলো? বিজ্ঞানীরা কি ইচ্ছেমতো যা তা বলেই বিভিন্ন জিনিসের মনগড়া বয়স বানিয়ে দিচ্ছে?
নাহ! মোটেও এমন কেউ করছে না।এই সব কিছুর পেছনে যেটি ভূমিকা রাখছে তা হলো কার্বন ডেটিং বা রেডিওমেট্রিক ডেটিং। পাঠক চলুন,শুরু করি কার্বন ডেটিং কীভাবে করা হয় অর্থাৎ এর পেছনে বিজ্ঞানটি কী সেটি সম্পর্কে।
নামটি থেকেই হয়তো একটা সাধারণ ধারণা চৌকস পাঠকেরা করে ফেলেছেন তা হলো ‘কার্বনের ডেট” বা সহজে কার্বনের তারিখ, ব্যাপারটি। আসলেই তাই, কার্বনটি আসলে কত সময় আগের তা জানাটাই মুখ্য।এর জন্য স্বল্প করে কয়েকটা নতুন শব্দ হয়তো চলে আসবে যেমন: “আইসোটোপ”, “নিউট্রন”, “পারমাণবিক সংখ্যা”, “তেজস্ক্রিয় মৌল”, “বিটা-ক্ষয়”, “ইলেকট্রন”, “নিউক্লিয়াস”, “প্রোটন”, “ভর সংখ্যা” ইত্যাদি। তবে আলোচনা করতে করতে এগুলো নিয়ে অবশ্যই জানবো।
একটা পরমাণু সাধারণভাবে “নিউট্রন”, “প্রোটন” , “ইলেকট্রন” এই তিনটি কণিকার দ্বারা গঠিত। প্রোটন ও নিউট্রন মিলে গঠিত হয় নিউক্লিয়াস, এবং ইলেট্রন এই নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে। এটাকে অবশ্য খালি চোখে দেখা যায় না।
তো এখানে বলা কার্বনটি একটি মৌল। আর বিশেষ ভাবে বলতে গেলে এটি একটি আইসোটোপ মৌল। সাধারণ অবস্থায় আমরা পৃথিবীতে যে কার্বন মৌলটিকে পাই সেটির ভর সংখ্যা ১২ এবং প্রোটন সংখ্যা ৬। এখানে ছোটো করে ভর সংখ্যা ব্যাপারটা কী তা জেনে রাখি। কোনো মৌলের একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসের মধ্যে অবস্থিত প্রোটন এবং নিউট্রনের মোট সংখ্যাকে ওই মৌলের বা পরমাণুর ভরসংখ্যা বলে । অর্থাৎ ভরসংখ্যা = প্রোটন সংখ্যা + নিউট্রন সংখ্যা। এই যে একটু আগে বলা কার্বনটির ভর সংখ্যা ১২ এবং প্রোটন সংখ্যা ৬, ঠিক তেমনি কিন্তু শুধু ভর সংখ্যা ১৪, এবং প্রোটন ওই আগেরটাই, এটাকেও কার্বন বলে। কিন্তু এটাকে বলা হয় কার্বনের আইসোটোপ। এবার এই আইসোটোপের ব্যাপারে অল্প করে জেনে নিই। যেসব পরমাণুর প্রোটন সংখ্যা সমান কিন্তু ভরসংখ্যা ভিন্ন হয়,সেসব পরমাণুকে পরস্পরের আইসোটোপ বলে ।
কার্বন মৌলের যে যে আইসোটোপ রয়েছে সেগুলোর নাম কার্বন-১২, কার্বন-১৩ এবং কার্বন-১৪। প্রকৃতিতে এই তিন রকমের কার্বনের সবগুলোই বিদ্যমান। কেউ কারো থেকে কম বা বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়,সব গুলোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতি কাউকে বেশি বা কম ভালোবাসে না। এখানে তিনটা আলাদা হলেও প্রতিটার ক্ষেত্রে প্রোটন সংখ্যাটা সেই একই অর্থাৎ ৬। পরীক্ষাগারে চেষ্টা করলে কার্বনের পরমাণুতে নিউট্রনের সংখ্যা ৫ করে কার্বন-১১ও তৈরি করা যায়। কিন্তু যেহেতু মাত্র ৫টি নিউট্রন কার্বনের ৬টি প্রোটনকে ঠিকমত সামলাতে পারে না, তাই কার্বন-১১ মারাত্মক তেজস্ক্রিয়।
কার্বন-১১ এর ৬টি থেকে ১টি প্রোটন ভেঙে গিয়ে ১টি নিউট্রন, ১টি পজিট্রন আর কিছু শক্তি তৈরি করে। নিউট্রনটি রয়ে যায়, আর পজিট্রনটি তেজস্ক্রিয় বিকিরণ সৃষ্টি করে পালিয়ে যায়। ফলে পড়ে থাকে শুধু বোরন-১১, যার প্রোটন সংখ্যা ৫ এবং নিউট্রন সংখ্যা ৬। আচ্ছা সে যাই হোক, কার্বন-১২ ,আর কার্বন-১৪ এই দুটি নিয়েই আলোচনার মুখ্য অংশ এগোবে। একটু আগেই বলেছিলাম, পৃথিবীতে সবচে বেশি পাওয়া যায় কার্বন-১২। আমাদের যে বায়ুমণ্ডল রয়েছে তাতে কার্বন-১৪-এর কিছু অংশ রয়েছে। এই কার্বন-১৪ দিয়েই আমরা কার্বন ডেটিং ব্যাপারটার মূলের দিকে যেতে পারবো।
কার্বন-১৪ কে ব্যবহার করা হয় কেন?
কারণ, কার্বন-১৪ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। কারণ এটি তেজস্ক্রিয় মৌল। এখানে স্বল্প করে জেনে নিই ”‘তেজস্ক্রিয় মৌল থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গমনের ঘটনাকে তেজস্ক্রিয়তা বলে”।
এবার বোঝার চেষ্টা করি,কার্বন-১৪ এই মৌলটি কীভাবে তৈরি হয়ে থাকে।
আমরা জানি, আমাদের বায়ুমণ্ডলের বেশ কয়েকটি স্তর আছে,
1. ট্রপোমণ্ডল (Troposphere),
2. স্ট্রাটোমণ্ডল (Stratosphere),
3. মেসোমণ্ডল (Mesosphere),
4. তাপমণ্ডল (Thermosphere),
5. এক্সোমণ্ডল (Exosphere) ও
6. চৌম্বকমণ্ডল (Magnetosphere)
আমরা প্রথম দিকে পড়েছি আইসোটোপ ব্যাপারটা কী, তাই সরাসরি লিখছি। নাইট্রোজেনের অনেকগুলো আইসোটোপ রয়েছে, যার মধ্যে নাইট্রোজেন-১৪ এই আইসোটোপটি বেশি পাওয়া যায়। এই আইসোটোপের শারীরিক বর্ণনা পাঠক দিতে পারবেন অবশ্যই। এর প্রোটন সংখ্যা ৭ এটি বলে দিলাম। আপনার ভরসংখ্যাটি কত তা বলতে পারবেন?
বায়ুমণ্ডলে তৈরি হওয়া নিউট্রনোর ভর সংখ্যা এক(১)। যেহেতু নিউট্রনোর কোন প্রোটন সংখ্যা নেই তাই সেটির প্রোটন সংখ্যা শূন্য। এই নিউট্রনটি নাইট্রোজেন-১৪-এর সাথে সংঘর্ষ ঘটায়।
যখন এই মুক্ত নিউট্রনটি নাইট্রোজেন-১৪-এর সাথে সংঘর্ষ ঘটায় তখন নাইট্রোজেনের নিউক্লিয়াসের মাঝে থাকা একটা প্রোটন বের করে দেয়। এবং সেই নিউট্রনটি নিজে সেখানে জায়গা করে নেয়। এখানে একটা প্রোটন কমে যাওয়ার কারণে সেটার পারমাণবিক সংখ্যা দাঁড়ায় ৬। পারমাণবিক সংখ্যা আর প্রোটন সংখ্যা একই। কিন্তু ভর যা ছিলো অর্থাৎ ১৪, সেটাই থেকে যাবে। এখন আমরা সাধারণভাবেই বলতে পারি প্রোটন সংখ্যা ৬ থাকার কারণে সেটিকে কার্বন বলাই যায়। তাহলে এখানে যেটা পাই আমরা তা হলো কার্বন-১৪। আর এই কার্বন-১৪ ব্যাপারটি কার্বন ডেটিং-এর জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু একটি প্রোটনকে বের করে দিয়েছিলো সেই বের হয়ে যাওয়া প্রোটনটি হয়ে যায় হাইড্রোজেন। আর যদি এই বের হয়ে যাওয়া প্রোটনটি মৌল না হয়ে যায়, তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত ইলেকট্রনের সাথে যুক্ত হতে না পায়, তার আগ পর্যন্তই বেচারা একা ঘোরে।
আমরা কার্বন-১৪-এর অবস্থাটি পেলাম। এটি আমাদের বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড আকারে থাকে। পরিমাণটা কিছুটা এমন: ১ ট্রিলিয়ন কার্বন-১২-এর মধ্যে, কার্বন-১৪-এর সংখ্যা ১ টা।
আমরা প্রাণী যারা অর্থাৎ পুরো প্রাণিজগত খাদ্যের জন্য নির্ভর করি উদ্ভিদের ওপর এবং উদ্ভিদ নির্ভর করে সূর্যালোকের উপরে। বায়ুমণ্ডলে থাকা কার্বন-১৪কে উদ্ভিদ শোষণ করে বায়ুমণ্ডল থেকে। কারণ উদ্ভিদের জন্য কার্বন ডাইঅক্সাইড খাদ্য। এখন বায়ুমণ্ডলে যে অনুপাতে কার্বন-১৪, কার্বন-১২ রয়েছে, ঠিক সেই অনুপাতে সচল প্রাণিজগত এটি গ্রহণ করে।
একই অনুপাতে প্রাণিদেহেও এটি চলে আসে।
এখন প্রশ্ন হলো, এই উদ্ভিদ এবং প্রাণিকুল যখন মারা যায়, তখন আসলে কী ঘটে?
স্বাভাবিক ভাবেই আমরা বুঝতে পাচ্ছি বায়ুমণ্ডল থেকে শরীরে কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগের ব্যাপারটি ঘটবে না এবং একই ভাবে উদ্ভিদের ক্ষেত্রে নতুন করে কোন কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণও হবে না।
তো এই অবস্থায় কার্বন-১৪ যেহেতু আর নতুন করে গৃহীত হবে না, বরঞ্চ যা জমা আছে সেগুলো ক্ষয় হওয়া শুরু করবে। কারণ, কার্বন-১৪ একটি তেজস্ক্রিয় মৌল।
কার্বন-১৪ এর অর্ধায়ু প্রায় ৫৭৩০ বছর। এটার মানে হলো, বর্তমানে যতটুকু কার্বন-১৪-এর পরিমাণ রয়েছে, ঠিক ৫৭৩০ বছর পর সেই কার্বনের পরিমাণ হয়ে যাবে অর্ধেক। আর কার্বনের এই ক্ষয়ের ফলে অর্থাৎ বিটা-ক্ষয়ের সাপেক্ষে আবারও কার্বন-১৪ মৌলটি নাইট্রোজেনে পরিণত হওয়া শুরু করবে। এই ঘটনার মধ্যে একটা ইলেকট্রনের বিকিরণ ঘটে, সেই সাথে অ্যান্টিনিউট্রিনোরও বিকিরণ ঘটে। এই পদ্ধতিকে বলে বিটা-ক্ষয়।
তাহলে এখানে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হওয়া গেলো। তা হলো বিটা-ক্ষয়ের ফলে কার্বন-১৪ মৌলটি নাইট্রোজেনে পরিণত হয়। সেক্ষেত্রে ভরসংখ্যা ১৪ই থাকে, প্রোটন শুধু ৬ থেকে ৭ হয়।
এখন যদি আমরা কোন ফসিল খুঁজে পাই, এবং সেটার বয়স বের করতে কী ঘটাতে হবে?
যা ঘটাতে হবে, তা হলো সেটার মধ্যে কতটুকু কার্বন-১৪ আছে,তা জানা গেলেই বয়স পেয়ে যাবো।
ধরে নিলাম, একটা ফসিল পাওয়া গিয়েছে এবং সেটার কার্বন-১৪-এর অনুপাত থেকে জানা গেলো সেটা ১১৪৬০ বছর আগের। তাহলে বুঝতে হবে ফসিলটি যদি প্রাণীর বা উদ্ভিদের হয়ে থাকে সেটি যখন মারা গেছে, সেই সময় থেকে বায়ুমণ্ডলের সাথে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণের অবস্থাও বন্ধ হয়ে গেছে। তার মাঝে যা স্থিতি রয়েছে সেটাও তেজস্ক্রিয় হওয়ার কারণে ক্ষয় হওয়া শুরু করে, কারণ নতুন কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। আর অনুপাতের পরিমাণ যদি প্রথম অবস্থায় থাকা কার্বন-১৪-এর পরিমাণের অর্ধেক হয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে এটি ৫৭৩০ বছর অতিক্রম করেছে, এবং সেটি যদি তারও অর্ধেক হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে এটির দ্বিগুণ বয়স হয়েছে।
এভাবেই পুরোনো ফসিলের বয়স নির্ধারণ করা হয়।
কার্বন ডেটিং ছাড়াও রয়েছে পটাশিয়াম-৪০, আর্গন-৪০, লেড-২০৬, ২০৭ ,ইউরেনিয়াম-২৩৮, ২৩৫, রুবিডিয়াম-৮৭, থোরিয়াম-২৩০, ২৩২, রেহনিয়াম-১৮৭, লুটেশিয়াম-১৭৬, ক্লোরিন-৩৬, সামেরিয়াম-১৪৭ এগুলোর দ্বারাও একইভাবে ডেটিং করা হয়।
কার্বন-১৪-এর দ্বারা ১০০-৫০,০০০ বছর পর্যন্ত সঠিক বয়সের অবস্থা পাওয়া যায়।
পটাশিয়াম-৪০-এর দ্বারা ১০০,০০০-৪.৫বিলিয়ন বছর পর্যন্ত সঠিক বয়সের অবস্থা পাওয়া যায়।
রুবিডিয়াম-৮৭-এর দ্বারা ১০ মিলিয়ন-৪.৫বিলিয়ন বছর পর্যন্ত সঠিক বয়সের অবস্থা পাওয়া যায়।
ইউরেনিয়াম-২৩৫-এর দ্বারা ১০মিলিয়ন-৪.৬ বিলিয়ন বছর পর্যন্ত সঠিক বয়সের অবস্থা পাওয়া যায়।