চাঁদের কক্ষপথের দোদুল্যমানতা ২০৩০ এর দশকে ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি করতে পারে

.

নিবন্ধ

Astronomy | জ্যোতির্বিজ্ঞান

চাঁদের কক্ষপথের দোদুল্যমানতা ২০৩০ এর দশকে ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি করতে পারে


জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ইতোমধ্যেই পৃথিবীর মানুষ ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হচ্ছে। বাদ পড়ছে না নিরীহ স্নিগ্ধ-শ্যামল প্রকৃতিও। সমগ্র প্রাণীজগতের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। কখনো ভয়াবহ দাবানলে ভস্মীভূত হয়ে, আবার কখনো মেরু অঞ্চলের বরফগলা প্রচন্ড ঠান্ডা জলে ভেসে। উভয় ক্ষেত্রেই সংকটে আছে এদের অস্তিত্ব। আর এর জন্য দায়ী শুধুমাত্র স্বঘোষিত সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ।পৃথিবীর তাপ বাড়ায় মেরু অঞ্চলের বরফ গলে বাড়ছে সমুদ্রতলের উচ্চতা। ঘন ঘন আঘাত হানছে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যার মতো ভয়ানক সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট গ্রিনহাউজ গ্যাসের দ্বারা পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে আবদ্ধ সৌরজগতের বিকিরিত তাপের পরিমাণের পার্থক্য (ছবিসূত্রঃ W. Elder,NPS)

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলে বিভিন্ন দুর্যোগের আঘাতের পাশাপাশি ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ এর মতো প্রভাব ফেলছে চাঁদের কক্ষপথের দোদুল্যমানতা। পৃথিবীর জলভাগের জোয়ার-ভাটা নিয়ন্ত্রিত হয় চাঁদের আকর্ষণে। সেই চাঁদ ধীরে ধীরে নিজের কক্ষপথ পরিবর্তন করছে অর্থাৎ পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ফলস্বরূপ পৃথিবীর জলভাগের উপর চাঁদের আকর্ষণ হ্রাস পাচ্ছে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে বাড়ছে সামুদ্রিক জোয়ারসৃষ্ট বন্যার পরিমাণ,যা “nuisance floods” নামে অধিক পরিচিত। ‘nuisance’ শব্দটি আক্ষরিক অর্থে ‘উপদ্রব’ বুঝায় এবং এই জাতীয় বন্যার জন্য নামটি যথপোযুক্ত। কারণ রাস্তাঘাট,অফিসের পার্কিং প্লট, বাড়িঘর আংশিক বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হবে আর নর্দমাগুলোর ময়লা পানি উপচে পড়ে। ফলস্বরূপ রাস্তাঘাটে গাড়ি এমনকি মানুষের চলাচলও বিঘ্নিত হয় চলমান জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে মানুষের জীবিকা স্থবির হয়ে পড়ে। সাধারণত জোয়ারের পানির উচ্চতা প্রতিদিনের জোয়ারের চেয়ে ২ ফুট(০.৬ মিটার) বৃদ্ধি পেলে এ ধরনের বন্যার প্রাদুর্ভাব হয়। এই দুর্যোগ যত বেশি সময় স্থায়ী হয়, এর প্রাদুর্ভাবে ক্ষতির সম্ভাবনা তত বেশি বৃদ্ধি পায়।


জোয়ারসৃষ্ট বন্যায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় বিপর্যস্ত জনজীবন

জাতীয় সামুদ্রিক ও বায়ুমণ্ডলীয় প্রশাসন ( NOAA) এর প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে আমেরিকা শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই  ৬০০ বারেরও বেশি সময় এই বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। NASA-এর গবেষণালব্ধ তথ্য এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক করে যে ২০৩০ সাল নাগাদ বন্যার উপদ্রব রেকর্ড পরিমাণে পুনঃপুন আঘাত হানবে আর ভয়াবহ বিপর্যয়ের মাধ্যমে জনজীবনকে বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন করবে। তাদের অনুমান অনুযায়ী, উপকূলীয় অঞ্চলে বন্যার পরিমাণ বর্তমানের চেয়ে ৩-৪ গুণ বেশি সংখ্যকবার হবে যদি না মানুষ এখনই ⚠ (সাবধান) হয়।

Nature Climate Change – এ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী এ ধরনের বন্যা পুরো বছর ধরে ছড়িয়ে না পড়লেও একসঙ্গে ৬ মাস যাবত বিস্তৃত থাকতে পারে। উপকূলীয় অঞ্চলগুলো প্রতি মাসে ডজনখানেক বা তারও বেশিবার আক্রান্ত হতে পারে যেখানে বর্তমানে ৩ থেকে ৪ বার বন্যার প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। ফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন গুরুতরভাবে বিপর্যস্ত হবে। যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে পৃথিবীর মানুষ ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে।

বেশ কয়েকটি কারণে এ ধরনের বন্যার প্রাদুর্ভাব  বাড়তে পারে। তার একটি সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হচ্ছে ফলস্বরূপ পৃথিবীর বিশাল পরিমাণ বরফ প্রতিনিয়ত গলে যাচ্ছে এবং সেই বরফগলা পানি বাড়িয়ে দিচ্ছে সমুদ্রতলের উচ্চতা।  তাই স্বাভাবিক জোয়ারের স্রোতের বদলে দেয়ে আসছে জোয়ারসৃষ্ট বন্যা। ১৮৮০ থেকে ২০২১ পর্যন্ত সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ৮ থেকে ৯ ইঞ্চি ( ২১-২৪ সে.মি.)যার তিন-চতুর্তাংশ ঘটেছে মাত্র গত ২৫ বছরে। ২১০০ পর্যন্ত যা পৌঁছাতে পারে যা ২০০০ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়া সমুদ্রতলের উচ্চতার তুলনায় ১২ ইঞ্চি ( ০.৩ মিটার)  থেকে ৮.২ ফুট (২.৫ মিটার) অবধি। পুরোটাই নির্ভর করছে মানুষ আগামী কয়েক দশক গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কতটা হ্রাস করতে পারে তার উপর।

উচ্চ জোয়ারসৃষ্ট বন্যার পৌনঃপুনিকতা বৃদ্ধিতে সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মহাকাশ বিশেষত চাঁদের এতে বেশ খানিকটা প্রভাব রয়েছে। যদিও সবসময় এই প্রভাব একইরকম নয়। যেহেতু জোয়ার-ভাটা প্রভাবিত হয় চাঁদের আকর্ষণে, তাই পৃথিবীর সাথে চাঁদের দূরত্বের পরিধি বাড়ার সাথে অসামঞ্জস্য প্রভাব পড়ছে। চাঁদের কক্ষপথে কম্পনের কারণে প্রতি ১৮.৬ বছরের আবর্তনে পৃথিবী ও চাঁদের দূরত্বের পরিবর্তন হয়। এর প্রথম অর্ধেক সময়ে, চাঁদের আকর্ষণ কম থাকায় পৃথিবীর জোয়ার হ্রাস পায় এবং জলভাগে নিম্ন জোয়ার আর উচ্চ ভাটা হয়। পরবর্তী অর্ধেক সময়ে জোয়ার বিবর্ধিত হয়ে উচ্চ জোয়ার আর নিম্ন ভাটা হয়। উচ্চ জোয়ারের সময়টাতেই  উপকূলীয় বন্যার প্রাদুর্ভাব বাড়ে। আমরা বর্তমানে এইরকম সময়টাতেই আছি। এর পরবর্তী জোয়ার বিবর্ধনের সময়টি ২০৩০’র দশকের মাঝামাঝি পর্যায়ে। ততক্ষণে সমুদ্রতলের উচ্চতা বেশি পরিমাণে বাড়বে ফলে জোয়ার বর্তমানের চেয়ে অত্যধিক পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে,যা অত্যন্ত বিপদজনক এবং ভয়াবহ সুনামির ইঙ্গিত। 

সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি ও চাঁদের কক্ষপথের কম্পন বা লুনার চক্র উভয়ের সমন্বিত প্রভাবে উপকূলজুড়ে জোয়ার সৃষ্ট বন্যা দ্রুত বাড়বে। এক দশকের মধ্যে এটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হবে। জলবায়ুর আরোও কতিপয় উপাদানের প্রভাবে বন্যার প্রাদুর্ভাব বছরের নির্দিষ্ট কোনো সময় পুরো মাসজুড়ে বিরাজ করবে। হয়ত বছরের প্রথম অর্ধেকের চেয়ে পরের অর্ধেকে আরোও বেশি ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন করবে।প্রতিমাসে ১০ থেকে ১৫ বার বন্যা হলে রাস্তাঘাট বন্ধ, জনজীবন স্থবির হয়ে পড়বে, মানুষ চাকরিচ্যুত হবে। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, নর্দমাগুলি গণস্বাস্থ্য-এর জন্য বিপদজনক হয়ে উঠবে।



সুতরাং অন্যান্য সব দুর্যোগের মতো এটিও অবজ্ঞা করা নিজের পায়ে কুড়োল মারার সামিল। তাই  দেরী হওয়ার আগেই দ্রুত প্রতিকারের পরিকল্পনা করাই উত্তম। [livescience.com অবলম্বনে]

-হৃদয় বিশ্বাস
মূল লেখা
https://bigganpotrika.com/2021/08/wobble-in-moon-orbit/

সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles