চাঁদ ধরার প্রতিযোগিতা
১৯৬৮ সাল থেকে চাঁদে মানুষ পাঠানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অধৈর্য হয়ে পড়ে। এর কারণ তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত ইউনিয়ন ততদিনে মহাকাশ বিজয়ের ক্ষেত্রে অনেক 'প্রথম'-এর মালিক হয়েছে।সেই 'প্রথম'গুলি কি কি?
চাঁদ নিয়ে দেখুন থিংকের ভিডিও চাঁদে কি মানুষ গিয়েছিলো?
* বিশ্বের প্রথম রকেট। যা পৃথিবীকে ঘুরে এলো। স্পুটনিক-০১। সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি।
* স্পুটনিক-০২ রকেটে করে 'লাইকা' নামের কুকুরকে মহাকাশে পাঠিয়ে প্রথম প্রাণী পাঠানোর কৃতিত্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের। দিন ছিলো ৩রা নভেম্বর, ১৯৫৭।
* ১৯৬১ সালের ১২ ই এপ্রিল ভস্টক-০১ রকেটে করে প্রথম মানুষ হিসেবে ইউরি গ্যাগারিন গেলেন মহাকাশে। কৃতিত্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের।
* এই ভস্টক সিরিজের ষষ্ঠ রকেট 'ভস্টক-০৬'-এ প্রথম নারী হিসেবে মহাকাশে গেলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভ্যালেন্তিনা তেরেস্কোভা।
এদিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিলো কিছুটা পিছিয়ে। প্রথম রকেট এক্সপ্লোরার তারা পাঠায় ১৯৫৮-এর জানুয়ারি মাসে। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রায় ১ বছর পিছনে। প্রথম মানুষ পাঠালো ১৯৬১ সালের ৫ই মে। সোভিয়েতের পরে। সেই সময়ে দুই রাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতেও ছড়িয়ে গেছে। তাই ঠান্ডাযুদ্ধ শুধু পৃথিবীর সীমায় আটকে রইলো না। তবে এতদিন যা ছিলো পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ভিতরেই ছিলো। আসল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ালো মাধ্যাকর্ষণ বল অতিক্রম করে পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে বের হওয়া। এজন্য দুই দেশের বিজ্ঞানীদের টার্গেট হয় চাঁদ।চাঁদে প্রথম মহাকাশযান কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নই পাঠিয়েছিলো। সোভিয়েত ইউনিয়নের যেই রকেট সিরিজ চাঁদে গিয়েছিলো তাঁর নাম 'লুনা'। লুনা সিরিজ সম্পর্কিত কিছু তথ্য দেখে নেয়া যাক:-
১) লুনা-০১ পৃথিবী থেকে উৎক্ষিপ্ত প্রথম মহাকাশযান যা ২রা জানুয়ারি, ১৯৫৯ তারিখে চন্দ্রবিজয়ের লক্ষ্যে প্রেরণ করা হয়। এটি চাঁদের ৫ থেকে ৬ হাজার কি.মি দূর থেকে একে অতিক্রম করে। লুনা-০২ সর্বপ্রথম চন্দ্রপৃষ্ঠে আঘাত করে এবং লুনা-০৩ পৃথিবীর প্রথম মহাকাশযান যা চাঁদের ছবি পৃথিবীতে পাঠায়।
২) ১৯৬৫ সালের ৩ রা ফেব্রুয়ারি ছাড়া হয় লুনা-০৯ যা পৃথিবীর প্রথম মহাকাশযান হিসেবে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করে।
৩) লুনা-১৬ যানটি চন্দ্রপৃষ্ঠের ৫০ সে.মি. গভীর থেকে ১০১ গ্রাম মাটি তুলে নিয়ে আসে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। কোনো মানুষের সাহায্য ছাড়া।
৪) লুনা-১৭ নভোযান মানুষের সাহায্য ছাড়াই চন্দ্রপৃষ্ঠে একটি গবেষণাগার স্থাপন করে আসে। যাঁর নাম ছিলো লুনাখোদ-০১। লুনাখোদ-০১ সৌরশক্তি দ্বারা চালিত হতো। এটি পৃথিবী থেকে রিমোট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো।
সুতরাং, বুঝতেই পারছেন চন্দ্রবিজয়ের রেসেও অনেকটা এগিয়ে ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাই ১৯৬৮ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র লক্ষ হয়ে ওঠে চাঁদে মানুষ পাঠানো। আর এই লক্ষ্যে তাঁরা যেই রকেট সিরিজটি চালু করে তাঁর নাম "অ্যাপোলো"।অ্যাপোলো-১১ এর আগে অ্যাপোলো-০৮ এবং ১০ নামে দুইটি মহাকাশযান পাঠানো হয়। চাঁদে সরাসরি রকেট থেকে নামার উপায় ছিলো না। রকেট থেকে চাঁদে নামতে হলে দরকার ছিলো লুনার মডিউল।তাই কিভাবে নামতে হবে? কোথায় নামতে হবে? ঝুঁকি কতটা? এসব জিনিস রেকি করতে অ্যাপোলো-০৮ এবং ১০ কে পাঠানো হয়৷ এই দুইটি যানেই মানুষ ছিলো। এরা চাঁদের ১০০ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বের ভেতর এসে ঘুরে যায়। ছবি তুলে নিয়ে যায়। এর ভেতর অ্যাপোলো-১০ চন্দ্রপৃষ্ঠের ১৫ কি.মি.-এর ভেতরে চলে আসে। তাঁদের ওপর দায়িত্ব ছিলো অভিযাত্রীদের অবতরণের যোগ্য সমতল ভূমির খোঁজ করা। কারণ, চন্দ্রপৃষ্ঠের সমস্তটাই ছিলো উঁচুনিচু আর পাথরে ভর্তি।
অনেক হিসেব-নিকেশ করে অবশেষে অ্যাপোলো-১১ কে চাঁদে পাঠানোর আয়োজন শুরু হয়।অভিযাত্রীদের প্রস্তুত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে তৈরি করা হলো চাঁদের অনুরূপ পরিবেশ। তৈরি হয়ে গেলো নকল চন্দ্র পৃষ্ঠ যাতে ছিলো মৃত আগ্নেয়গিরি, ছড়িয়ে দেয়া হলো প্রচুর আগ্নেয়গিরি। চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পৃথিবীর ছয় ভাগের একভাগ। সেখানে মানুষ বেশি হাল্কা অনুভব করে। টেক্সাসে কৃত্রিমভাবে সেই পরিবেশও সৃষ্টি করা হলো।তিন অভিযাত্রী নীল আর্মস্ট্রং, এডুইন অলড্রিন আর মাইকেল কলিন্স ছিলেন জেটবিমান চালানোয় অভিজ্ঞ। জেটবিমানের ইঞ্জিন আর নভোযানের ইঞ্জিনের মধ্যে অনেক মিল থাকায় হিসাব করেই তাঁদের নেয়া হয়েছিলো।অ্যাপোলো-১১-এর ওজন ছিলো ৩,০০০ টন। উচ্চতা ৩৬তলা ভবনের সমান। নভোযানটি ছিলো প্রধানত দু'টি অংশের সমন্বয়। এর প্রথম অংশটি ব্যবহৃত হতো কন্ট্রোল রুম হিসেবে আর দ্বিতীয় অংশটি ছিলো লুনার মডিউল।
১৯৬৯ সালের ১৬ ই জুলাই ফ্লোরিডার জন এফ কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে অ্যাপোলো-১১ উৎক্ষিপ্ত হয়। আর ২১শে জুলাই এটি চাঁদের পৃষ্ঠে পৌঁছায়। ১৯৬৯ সালের ২১শে জুলাই বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা ১৭ মিনিটে প্রথম মানুষ হিসেবে নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের বুকে পা রাখেন। এর ২০ মিনিট পর এডইন অলড্রিন চাঁদের বুকে নেমে আসেন। তাঁরা মোট ২২ ঘন্টা চাঁদের পৃষ্ঠে ছিলেন। এর মধ্যে ২ ঘন্টা ১৩ মিনিট তাঁরা চন্দ্রপৃষ্ঠে বিচরণ করেন। সারাবিশ্বের মানুষ টেলিভিশনে এই ঘটনা লাইভ দেখেছিলো। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি ছিল রাজনৈতিক বিজয়। চাঁদে বসে নিল আর্মস্ট্রং-এর সাথে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কথা হচ্ছিলো। প্রেসিডেন্ট বললেন, "নিল, আমি হোয়াইট হাউজ থেকে বলছি। আমার মনে হয় না এর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ টেলিফোন এখান থেকে আগে করা হয়েছে।" মহাকাশ বিজয়ের রেসে সবচাইতে গুরত্বপূর্ণ "প্রথম"টির কৃতিত্ব নিতে পারাটাই ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের বিজয়। আর মানবজাতির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো? সেটি নিল আর্মস্ট্রং-এর ভাষায় বলা যাক -
One Small step for man, a giant leap for mankind.
সূত্র: বিশ্বজয়ের কথা - ভবেশ রায়
লেখা: অঞ্জন রানা