সাবান কীভাবে করোনাভাইরাসকে ভাঙ্গতে পারে

.

নিবন্ধ

Coronavirus | করোনা ভাইরাস

সাবান কীভাবে করোনাভাইরাসকে ভাঙ্গতে পারে

সাবান জন্ম থেকে পরিচিত, এবং ভাইরাসকে মারতে পারে এমন অল্প কিছু জিনিসের মধ্যে সবচাইতে সহজলভ্য

 

সাবানের আবিষ্কার সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না, তবে ধারণা করা হয়, প্রাচীন পৃথিবীতে প্রাণী পুড়িয়ে খাওয়ার পর মানুষ দেখেছিল, ছাই আর প্রাণীদেহ থেকে ঝরে যাওয়া চর্বি বৃষ্টির পানিতে ফেনা তৈরি করে, এবং সেই ফেনা দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করা সহজ হয় সেই থেকে চর্বি আর ছাই মিশিয়ে সাবান তৈরির শুরু

 

সাবানের প্রতিটা অনু দেখতে আলপিনের মতএকদিকে গোল একটা মাথা, তার সাথে একটা লম্বা লেজ (ছবি) মজার ব্যাপার হচ্ছে, গোল মাথাটা পানিকে পছন্দ করে, পানির সাথে মিশে যায়, তাই সেটার নাম জলাকর্ষি (হাইড্রোফিলিক, hydrophilic, hydro = পানি, -phile = ভালবাসে, আকর্ষিত হয়) আর লেজটা পানিকে অপছন্দ করে, পানি থেকে পালায়, তাই সেটার নাম জলাতঙ্কি (হাইড্রোফোবিক, hydrophobic, hydro = পানি, -phobia = ভয় পাওয়া) লেজটা পানিকে অপছন্দ করলেও আবার চর্বিকে পছন্দ করে, তাই সেটা চর্বিবান্ধবও বটে  (lipophilic, Greek lipos “fat, grease‌” + phile )

 

যদি সাবান যদি পানিতে মেশানো হয়, তাহলে এই অনুগুলি একটা আরেকটার সাথে জোড়া লাগে কীভাবে লাগে? উপরে সেটার একটা আভাস দেয়া আছে জলাকর্ষি মাথাটা পানির অনুর সাথে লেগে যায় আর জলাতঙ্কি লেজটা পানি থেকে পালানোর চেষ্টা করে পানির থেকে উল্টো দিকে মুখ করে মনে করুন রাস্তায় ড্রেনের পানি থাকলে জুতা বাচানোর জন্য যেভাবে আঙ্গুলের ওপর হাটার চেষ্টা করি আমরা বাকি পা বাচিয়ে, অনেকটা সেই রকম কিন্তু সব জলাতঙ্কি লেজ তো একসাথে পালাতে পারবে না পানি চারদিকে, সব কয়টা লেজ এক সাথে পালানোর চেষ্টা করছে, আর সব কয়টা মাথা পানির দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে তাহলে কী হবে? ফলাফলঃ একটা গোল বলের মত আকৃতি, যার দেয়াল সব মাথা দিয়ে তৈরি আর বলের ভেতরে সব লেজ, পানি থেকে লুকিয়ে আছে  এটাকে মাইসেল (micelle) বলা হয়

 

বোঝার সুবিধার্থে ধরে দিন, এটা আমাদের খুব পরিচিত একটা জিনিসবুদবুদ অনেকগুলি ছোট বুদবুদকে আমরা ফেনা হিসাবে দেখি কিন্তু এই বুদবুদ কীভাবে আমাদেরকে সাহায্য করে?

 

শুধু পানি দিয়ে তেল/চর্বি ধুতে গেলে লাভ হয় না আমরা জানি, তেল আর পানি মেশে না, কারন তেল/চর্বি নিজেও জলাতঙ্কি, তাই পানিকে দূরে সরিয়ে রাখে এখন তেলে যদি সাবান-পানির মিশ্রণ দেয়া হয়, জলাতঙ্কি লেজটা তেলকে বলে, আয়, তুইও পানিকে পছন্দ করিস না, আমিও করি না চল আমরা দুইজন এই বুদবুদের ভেতরে শুকনা আর আরামে থাকি যেই বুদবুদের ভেতরে তেলের কনাটা ঢুকলো, তখন তার চারপাশে কিন্তু বুদবুদের দেয়াল, যেটা পানিকে অপছন্দ করে না এবার পানি দিয়ে সেই বুদবুদ (যেটার ভেতরে তেলটা আটকে আছে) সহজেই সরিয়ে ফেলা যায়

 

মজার ব্যাপার হচ্ছে, কিছু ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাস আছে যেগুলির দেয়াল বা কোষ লিপিড (lipid: lipos = fat, -ide: রাসায়নিক যৌগের নামের অংশ) দিয়ে তৈরি ঐ দেয়ালটা দুই স্তরের মাইসেল, অনেকটা সাবানের মাইসেলের মতই, কিন্তু এখানে দুই স্তর জলাতঙ্কি লেজ দুই স্তর জলাকর্ষি মাথার মধ্যে স্যান্ডউইচের মত হয়ে আছে

যখন আমরা সাবান পানি দিয়ে হাত ধুই, সাধারণ তেল-চর্বির মতই সাবানের মাইসেলের ভেতরে শুধু হাতে লেগে থাকা ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস মাইসেলের ভেতরে ঢুকে যায়, ফলে সেগুলিকে ধুয়ে ফেলা সহজ হয় শুধু তাই না, সাবানের জলাতঙ্কি লেজগুলি পালানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে, এবং তারা ভাবে, একটা চর্বির দেয়াল দেখতে পাচ্ছি ঐখানে গিয়ে লুকাই কিন্তু ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার দেয়াল তো সাবানের লেজকে জায়গা দেয়ার কথা মনে করে বানানো হয় নাই ফলে মোটা মানুষ বেশি খেলে যেভাবে শার্টের বোতাম ছিড়ে ভুড়ি বের হয়ে আসে, তেমনি সাবানের লেজগুলি জোর করে ঢুকে যাওয়ায় ভাইরাসের দেয়ালও ভেঙ্গে যায় এবং ভেতরের সব কিছু বের হয়ে আসে সেগুলি তখনও সাবানের মাইসেলের ভেতরে আটক হয়ে আছে, এবং তখন পানি দিয়ে ধুয়ে তাদের দূর করে ফেলা যায়

কোনকোন ব্যাক্টেরিয়া আর ভাইরাসের দেয়াল চর্বির তৈরি? বিশাল সব ঘাতক তারা: সব করোনাভাইরাস (সার্স, মার্স, কোভিড-১৯), এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি ও সি (জন্ডিস), হার্পিস, এবোলা, জিকা, ডেঙ্গে (ডেঙ্গু), এবং পেট ও শ্বাসনালীকে আক্রমণ করে এমন অনেক ব্যাকটেরিয়া

 

আর যদি চর্বির দেয়াল ভাঙ্গতে না পারে? তাহলেও যে রাসায়নিক বন্ধনে বা আকর্ষনে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া আমাদের হাতে বা শরীরে আটকে থাকে, সেগুলিকে সাবান ভাঙ্গতে পারে তাই ধ্বংস না করতে পারলেও হাত/শরীর থেকে তাড়ানোর জন্য সাবান খুব ভাল কাজ করে

 

শেষ কথা: হ্যান্ড স্যানিটাইজার সাবানের চাইতে অনেক কম কার্যকর ৬০% অ্যালকহলওয়ালা স্যানিটাইজার ভাইরাসের লিপিডের দেয়াল ভাঙ্গতে পারে, কিন্তু যেগুলিকে ভাঙ্গতে পারে না, সেগুলিকে চামড়া থেকে সরাতে পারে না তাই সাবান দিয়ে হাত ধুলেই হবে। সাবান আর পানি না থাকলে তখন হ্যান্ড স্যানিটাইজারের প্রশ্ন।

 

হাঁচি কাশি এলে নিজের কনুইয়ে মুখ গুজে দিন, যাতে না সেটা না ছড়ায় আশেপাশে কেউ হাচি-কাশি দিলে তার থেকে দূরে থাকুন আর নিজের হাত সাবান দিয়ে না ধুয়ে মুখে, চোখে বা নাকে না দেয়ার চেষ্টা করুন  সাবান আর পানি দিয়ে কীভাবে হাত ধোবেন? মনে করুন মরিচের গুড়া হাতে মাখানো, কিন্তু আপনার চোখ চুলকাচ্ছে, তাই হাত ধুতে হবে সুতরাং যত্ন সহকারে অন্তত ২০ সেকেন্ড ধুয়ে নিন  ২০ সেকেন্ড কতক্ষন? হাত ধোয়ার সময় একহাজার এক, একহাজার দুই, এভাবে গুনুন একহাজার বিশ পর্যন্ত গোনা শেষ হলে হাত ধোয়া বন্ধ করতে পারবেন

 

সবাই সুস্থ থাকুন, ভাল থাকুন

* জলাতঙ্কি লেজ আসলে কোন ভাবনাচিন্তা করে না এটার কোন প্রাণ বা বুদ্ধিমত্তা নেই; শুধু রাসায়নিক কারণে এই কাজগুলি হয় ব্যাখ্যাটা সহজে করার জন্যভাবে”, “পালায়এই সব ক্রিয়াপদ ব্যবহার করেছি

সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles