প্রজাতির উৎপত্তিতে বিচ্ছিন্নতার শক্তি পর্ব- ২

.

নিবন্ধ

Evolution | বিবর্তন

প্রজাতির উৎপত্তিতে বিচ্ছিন্নতার শক্তি পর্ব- ২

গ্যালাপাগোস দ্বীপে বিবর্তনের মাধ্যমে তিন প্রজাতির ল্যান্ড ইগুয়ানার উৎপত্তি হতে কয়েক হাজার বছর লেগেছে মাত্র। কয়েক মিলিয়ন বছর পর্যন্ত যদি অপেক্ষা করি বিবর্তিত হওয়া ঐ সময়ের প্রাণীগুলোর সাথে যদি আজকের তুলনা করে দেখি তাহলে উভয়ের পার্থক্য হবে কল্পনাতীত পরিমাণ বিশাল। অনেকটা তেলাপোকার সাথে কুমিরের তুলনা করে দেখার মতো। বরাবরের মতো আবারো বলছি এই ব্যাপারটাই ঘটেছে সমস্ত জীব জগতের ক্ষেত্রে। এটা সত্য যে তেলাপোকার দাদার দাদার দাদার … … … দাদার এমন এমন একটি পূর্বপুরুষ ছিল যে কিনা আজকের কুমিরেরও দাদার দাদার দাদার … … … দাদার পূর্বপুরুষ। তেলাপোকা ও কুমির একই পূর্বপুরুষ থেকে বিশ্লিষ্ট হয়েছিল।

সময়ের উল্টোদিকে এগোতে থাকলে একসময় না একসময় তেলাপোকা ও কুমিরের পূর্বপুরুষ একই সদস্যে গিয়ে মিলিত হবে। এর জন্য হয়তো আমাদেরকে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর পরিমাণ পেছনে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু তারপরেও অনেক পূর্বপুরুষ অতিক্রম করে তেলাপোকা ও কুমিরের একই পূর্বপুরুষের দেখা পাবো।

এত বছর আগে তাদের প্রজাতিগত বিভাজনের জন্য কোন পরিবেশটি বাধা হিসেবে ভূমিকা পালন করেছিল তা এতদিন পরে এসে ঠিক ঠিকভাবে জানা কষ্টকর। যেভাবেই এটা হয়ে থাকুক তা হয়েছে সমুদ্রের পরিবেশে। কারণ ডাঙায় কোনো প্রাণীর অস্তিত্বই ছিল না। সম্ভবত তেলাপোকা ও কুমিরের অতি-আগের পূর্বপুরুষের সন্তান অগভীর সমুদ্রের শৈবাল সম্বলিত এলাকায় বসবাস করেছিল এবং অনুধাবন করেছিল গভীর সমুদ্রের বৈরি পরিবেশের তুলনায় এই পরিবেশ বেশ উত্তম। অন্তত তাদের জন্য উত্তম। অগভীর সমুদ্র থেকেই ধীরে ধীরে ডাঙায় এসেছিল তেলাপোকার পূর্বপুরুষ।

মাত্র ৬ মিলিয়ন বছর আগে ফিরে গেলেই আমরা মানুষের এমন পূর্বপুরুষের দেখা পাব যে কিনা আজকের শিম্পাঞ্জিদেরও পূর্বপুরুষ। এই সময়টা খুব একটা বেশি নয়। ফলে তেলাপোকা ও কুমিরের মতো এখানে মানুষ ও শিম্পাঞ্জিদের বিভাজনে বাধা হিসেবে কী কাজ করেছে তার সম্পর্কে ধারণা লাভ করা খুব একটা কঠিন নয়। ধরে নেয়া হয় আফ্রিকার গ্রেট রিফট ভ্যালি বাধা হিসেবে কাজ করেছিল। গ্রেট রিফট ভ্যালি হচ্ছে ৫ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ একটি উপত্যকা যা এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ হতে শুরু করে আফ্রিকা মহাদেশের পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত।

গ্রেট রিফট ভ্যালির পূর্বদিকে বিবর্তিত হয়েছে মনুষ্য প্রজাতি আর পশ্চিম দিকে বিবর্তিত হয়েছে শিম্পাঞ্জি প্রজাতি। পরবর্তীতে শিম্পাঞ্জিদের ধারা দুটি ভাগে বিভক্ত হয় সাধারণ শিম্পাঞ্জি ও পিগমি শিম্পাঞ্জিতে (বেবুন)। ধারণা করা হয় বিভক্ত হবার জন্য কঙ্গো নদী তাদের মাঝে বাধা হিসেবে কাজ করেছিল। এই হিসেবে ১৮৫ মিলিয়ন বছর আগের সময়ে গেলে আমরা এমন এক প্রাণীর দেখা পাব যে আজকের যুগের সকল প্রকার স্তন্যপায়ী প্রাণীর পূর্বপুরুষ।

স্তন্যপায়ীরা প্রাণিজগতে তুলনামূলকভাবে উন্নত মস্তিষ্কের অধিকারী। অতি-আগের পূর্বপুরুষের বংশধরদের মাঝে প্রজাতিগতভাবে একের পর এক বিভাজন সম্পন্ন হয়েছে। অল্প সময়ের মাঝেই স্তন্যপায়ীর হাজার হাজার প্রজাতিতে ছেয়ে গেছে সমস্ত পৃথিবী। স্তন্যপায়ীর ঘরে আছে ২৩১ প্রজাতির মাংসাশী (কুকুর, বিড়াল, বাঘ, ভালুক ইত্যাদি), ২ হাজার প্রজাতির ইঁদুর জাতীয় প্রাণী বা Rodent, ৮৮ প্রজাতির তিমি ও হাঙর জাতীয় প্রাণী, ১৯৬ প্রজাতির দ্বি-খণ্ডিত ক্ষুর বিশিষ্ট প্রাণী (গরু, ভেড়া, হরিণ, শূকর ইত্যাদি- এদের পায়ের ক্ষুর দ্বি-খণ্ডিত থাকে), ১৬ প্রজাতির ঘোড়া জাতীয় প্রাণী (ঘোড়া, জেব্রা, গণ্ডার ইত্যাদি), ৮৭ প্রজাতির খরগোশ জাতীয় প্রাণী, ৯৭৭ প্রজাতির বাদুড়, ৬৮ প্রজাতির ক্যাঙ্গারু, ১৮ প্রজাতির এপ (এদের মাঝে মানুষও আছে), এবং অন্যান্য অনেক অনেক অনেক প্রজাতি যা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।

এত পরিমাণ স্তন্যপায়ী প্রাণীর পূর্বপুরুষ যিনি তার দেখা যদি পেতাম তাহলে বাংলাদেশের সাংবাদিক ধাঁচে প্রশ্ন করতাম, “সমস্ত পৃথিবী ভরিয়ে দেয়া এত পরিমাণ প্রজাতির পূর্বপুরুষ হতে পেরে আপনার অনুভূতি কী?”

লক্ষ লক্ষ প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের উপস্থিতিতে পৃথিবীতে বিরাজ করছে চমৎকার এক বৈচিত্র্য। আর এই বৈচিত্র্যময়তার পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হিসেবে কাজ করেছে বিচ্ছিন্নতা। একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে থাকা। বিচ্ছিন্নতা নেতিবাচক, আমরা কেউ বিচ্ছিন্ন হতে চাই না। কিন্তু তারপরেও বৈচিত্র্যময় পৃথিবীর জন্য বিচ্ছিন্নতার শক্তিকে ধন্যবাদ দিতে হয়।

সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles