মানুষ পৃথিবীর একমাত্র প্রজাতি যে কিনা নিজের দেহের ত্বকের রং নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। বাঘ, হরিণ, তিমি, গরু, মুরগি কিংবা মাগুর মাছ ইত্যাদি কোন প্রাণী কখনওই নিজের গায়ের রং নিয়ে অসন্তুষ্ট নয়, এর কারণ সম্ভবত তারা নিজেদের জীবনযাপন নিয়েই বেশী ব্যস্ত আর অপ্রয়োজনীয় চিন্তা করার ক্ষমতাও তাদের নেই। কিন্তু মানব জাতির মস্তিষ্ক জীবনযাপন ছাড়াও নানান অপ্রয়োজনীয় চিন্তা করতে সক্ষম; তার মধ্যে গায়ের রং নিয়ে চিন্তাভাবনা মানুষ এত বেশী করেছে যে এর থেকে জন্ম হয়েছে বর্ণবাদের এবং আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের ধরে এনে সাদা চামড়ার পশ্চিমারা তাদের দাস হিসেবে ব্যবহার করেছে। শরীরের চামড়া উজ্জ্বল ও সাদা বলে ইউরোপীয় ও আমেরিকানরা মনে করত তারা নিজেরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আর কালো মানুষেরা নিকৃষ্ট। তবে সেই দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে কিন্তু কালো মানুষদের প্রতি অবজ্ঞা কি আজও দূর হয়েছে? আমেরিকায় সাম্প্রতিক বর্ণবাদের ঘটনা, যেখানে জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গকে পুলিশ শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে, আমাদের মনে করিয়ে দেয় মানুষের মনে গায়ের চামড়া নিয়ে ক্ষতিকর এই চিন্তাভাবনা এখনও বন্ধ হয়নি।
মানুষের গায়ের রং কত প্রকার দেখা যায়? কেন মানুষের গায়ের রং কারও ফর্সা, কারও কালো, কারওবা শ্যামলা, আবার কেউবা উজ্জ্বল শ্যামলা? কিন্তু মানুষের গায়ের রং-এর এতো তফাত কেন হয়? ফর্সা মানেই সুন্দর, আর কালো হয়ে জন্মেছেন মানেই অসুন্দর, খারাপ। কালো মেয়ের বিয়ে হবে না ভেবে আমাদের দেশের বাবা মায়ের আজো সে কী চিন্তা! শুধু আমাদের কথাই বলি কেন, এই গায়ের রঙের অজুহাত দিয়ে মাত্র কয়েকশ' বছর আগেও, ইউরোপ, আমেরিকাতে হালাল করা হয়েছিল আফ্রিকার কালো মানুষদের দাসত্ব। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও সত্যি যে গায়ের রঙের ভিত্তিতে আমেরিকাতে ষাটের দশক পর্যন্ত, সাউথ আফ্রিকাতে ৯০-এর দশক পর্যন্ত, কালোদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানিয়ে রাখা হয়েছিল। কাগজে কলমে সমানাধিকার পেলেও এখনো তাঁরা লড়াই করে চলেছেন এই বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে।
“ কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো যারে বলে গায়ের লোকে ” গায়ের রঙ ফর্সা না হওয়ার তীব্র গ্লানি, অবজ্ঞা আর অবহেলাতে কবিগুরুর কৃষ্ণকলি অমর হয়ে রয় শুরু গানেকবিতাতে৷ অথচ সমাজ এই গায়ের রংটাকে কালো বলেও সম্বোধন করে না। বলে, মেয়েটার গায়ের রঙ কেমন যেন, ময়লা, চাপা ইত্যাদি ইত্যাদি। ঘরে-বাইরে, স্কুল-কলেজে, বিয়েতে-অনুষ্ঠানে, বন্ধু- বান্ধবদের কাছে এই গায়ের রঙ কালো বলে মেয়েদের কম হেয় হতে হয় না৷ মজার ছলে হলেও বহু কথা মুখ বুঝে হজম করতে হয় তাদের। এখন হয়তো বলবেন কালো মেয়েদের কথা কেন বলছি শুধু! বলা বাহুল্য, গায়ের রঙ নিয়ে বিড়ম্বনা ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের বেশি। কিন্তু কালারিজম এতো সুক্ষ্মভাবে আমাদের মধ্যে গেঁথে গেছে যে ২০১৫ সালে ছোট পর্দার অভিনেত্রী সুমাইয়া শিমু বিয়ে করেন নাসিরুদ্দিন নাসিমকে, যাঁকে সমালোচনার শিকার হতে হয় গায়ের রঙ কালো হওয়ায়। তাঁকে নাকি অভিনেত্রীর সাথে মানায় না! একজন অভিনেত্রীর স্বামীকে যদি এভাবে হেয় করা হয় তাহলে সাধারণ মেয়েদের কি অবস্থা কালারিজমের জঘন্য চাকায় পিষ্ট হয়ে তা একটু হলেও আঁচ করতে পারবেন। জিনিসটা ভালমত ধরিয়ে দিতে আরেকটা ঘটনা বলি-
সেই দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে কিন্তু কালো মানুষদের প্রতি অবজ্ঞা কি আজও দূর হয়েছে? আমেরিকায় সাম্প্রতিক বর্ণবাদের ঘটনা, যেখানে জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গকে পুলিশ শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে, আমাদের মনে করিয়ে দেয় মানুষের মনে গায়ের চামড়া নিয়ে ক্ষতিকর এই চিন্তাভাবনা এখনও বন্ধ হয়নি।
কেন মানুষের মধ্যে এত রকমের গায়ের রং দেখা যায়? গায়ের রঙের এই সাদা-কালো বলতে আসলে কী বোঝায়? এর ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের বা সামাজিক নিপীড়নের কি আসলেই কোন ভিত্তি আছে?
২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল নারায়নগঞ্জের রুপগঞ্জে সাথী আক্তার নামে এক গৃহবধূকে পুলিশ উদ্ধার করার পর তিনি পুলিশ কে জানান, কালো ও খাটো হওয়ার কারণে গত ছয় মাস ধরে তাঁর উপর নির্যাতন করছিলো তার স্বামী ফাহিম। তাঁকে জোর করে বিষপান করিয়ে হত্যার চেষ্টাও করা হয়।