সুনামি কেন এতো ভয়ংকর হয়ে ওঠে? সুনামিতে বাংলাদেশ কতখানি ঝুঁকিতে?

.

তীরে আছড়ে পড়া ক্লান্তিহীন, বিরতিহীন সমুদ্রের ঢেউ দেখে কে না মুগ্ধ হয়? কিন্তু সেই ঢেউই যদি হঠাৎ ফুঁসে উঠে দানবের মতো?- ভেঙ্গেচুরে, ভাসিয়ে দেয় সবকিছু?

এই তো ২০০৪ সালেই সুমাত্রার কাছে ৩০ মিটার উঁচু সুনামির ঢেউয়ের ধ্বংসযজ্ঞে মারা গিয়েছিল লাখেরও বেশি মানুষ  ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল ১৪ টি দেশ!

হ্যাঁপ্রায় ১০ তলা বিল্ডিং এর সমান উঁচু ঢেউ ধেয়ে এসেছিল একটা জেট প্লেনের মত গতিতে সেদিন!

- কিন্তু কি এই সুনামি? কেন এবং কীভাবে সৃষ্টি হয়, কেন হয়

- কত ভয়ংকর হতে পারে সে? আর আমাদের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোই বা কতখানি ঝুঁকিতে আছে

আসুন তাহলে আজকে থিংকের বন্ধু, Jacksonville State University Professor এবং Emergency Management এর Department Head  . তানভীর ইসলামের কাছ থেকে জেনে নেই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর।

সুনামি আর জলোচ্ছ্বাস কিন্তু আবার এক নয়। জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয় বায়ু প্রবাহের বা ঘূর্ণিঝড়ের কারণে, আর সেটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বা দুটো ঢেউয়ের চূড়োর মধ্যে দূরত্ব থাকে কমকিন্তু সুনামির ক্ষেত্রে এই তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হয় অনেক বেশি।

সুনামি জাপানি শব্দ  - যার কাব্যিক পরিভাষা বন্দরের উর্মিমালা বা ঢেউ।

সাগর কিংবা কোনও প্রকান্ড জলাধারে হঠাৎ কোনও দুর্যোগের ফলে যে ধারাবাহিক বিশালাকৃতির ঢেউ তৈরি হয় তাইই মূলত সুনামি। 

তাহলে  সুনামি সৃষ্টি হয় কীভাবে

সুনামি জলে  তৈরি হলেও, প্রায় ৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই এই বিপর্যয়ের মূল কারণ হচ্ছে সমুদ্রের তলদেশের  ভূমিকম্প। 

আর বাদবাকি ক্ষেত্রে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, ভূমিধ্বস, বিস্ফোরণ, উল্কাপাতও সুনামির কারণ হতে পারে।

থিংকের আগের এক ভিডিওতে আমরা দেখেছি, কিভাবে টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষে ভূমিকম্প ঘটে।  সমুদ্রের তলায় ভূমিকম্পের কারণেতলদেশের উচ্চতা বদলে যেতে পারে, যার সাথে সাথে  পানির উচ্চতাও দ্রুত বদলায়, অর্থাৎ পানির স্থিতিশক্তি পালটায়। আর এই পরিবর্তিত স্থিতিশক্তি রূপ নেয় গতিশক্তিতে। ফলে জন্ম নেয় সুনামি, যা প্রায় ঘন্টায় ৫০০ মাইল বেগে  বা একটি জেট প্লেনের গতিতে ধেয়ে আসতে পারে।

উপকূলের কাছে সমুদ্রের পানির গভীরতা কম। তাই যখন ধেয়ে আসা জলরাশি সেটায় ধাক্কা খায়, তখন বেগ কিছুটা কমে গেলেও ঢেউয়ের উচ্চতা অস্বাভাবিক রকম বেড়ে গিয়ে প্রলয়ংকরী আকার ধারণ করতে পারে। 

আবার সমুদ্রের তলদেশে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত সুনামির আরেকটি বড় কারণ।

১৮৮৩ সালে ক্রাকাতোয়া দ্বীপের অগ্নুৎপাত থেকে তৈরি সুনামিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৩০ হাজার মানুষ।

ভূমিকম্পের মতোই এই আগ্নেয়গিরি থেকে প্রচন্ড লাভা উদগীরনের ফলেও সমুদ্রের তলদেশের ভূমির ধরণ পাল্টে যেতে পারে -> আর  এর ফলাফল  হতে পারে ঠিক ভূমিকম্প থেকে তৈরি হওয়া সুনামির মতোই। 

সমুদ্র, মহাসমুদ্রের চেয়ে ছোট জলাধার যেমন ধরুন হ্রদ বা উপসাগরের নিচের ভূমিধ্বসওএমনকি  মাটির উপরের ভূমিধ্বস থেকেও স্থানীয়ভাবে সুনামি তৈরি হতে পারে।

১৯৫৮ সালে আলস্কার Lituya Bay তেপার্শ্ববর্তী এলাকার,এক ভূমিকম্পের ফলে কোটি কিউবিক মিটারের প্রকাণ্ড এক পাথর ধ্বসে পড়ে এবং তা থেকে তৈরি হয় ->এক মেগা-সুনামির।

এছাড়াও সমুদ্রের তলদেশের ভূমির দোদুল্যমানতা বা সমুদ্রের অনেক নিচের ভূকম্পনও  থেকে  ভূপ্রকৃতি বদলে না গেলেও  উপরের জলরাশিকে প্রচন্ড শক্তিতে ঠেলে দিতে পারে। 

কিন্তু কতটা বিধ্বংসী হতে পারে এই সুনামি?

সুনামির তীব্রতা নির্ভর করে

র‍্যাপচার জোন বা যে অংশে ভূমির ভাঙ্গন হচ্ছে তার আকার, কতটা দ্রুত সেই অংশ সরে যাচ্ছে এবং কী পরিমাণে সরছে, সেই সাথে আবার ভূমিকম্পের কেন্দ্রের কম্পনের  গতি এবং পানির গভীরতার উপর। 

সুনামি কিন্তু নতুন কোন ঘটনা নয়। ইতিহাসের পাতায় আজ থেকে হাজার বছর আগে সিরিয়ার উপকূলে প্রথম সুনামির ঘটনার উল্লেখ দেখা যায়। ১৯০০ সাল থেকে বিজ্ঞানিরা সুনামির তথ্য সংগ্রহ করছেন এবং তা থেকে বোঝা যায় যে, প্রশান্ত মহাসাগরের দুই দিকে থাকা দেশগুলো যেমন জাপান, নিউগিনি, সলোমান দ্বীপপুঞ্জ, আবার ওদিকে পেরু, চিলি সুনামির ছোবলে আক্রান্ত হওয়ার শীর্ষে আছে কারন এই অঞ্চলে  পানির নিচে প্রচুর সক্রিয় আগ্নেয়গিরি আছে।

২০১১ সালের মার্চ মাসের ১১ তারিখে  - জাপানের উপকূলে রিখটার স্কেলে মাত্রার এক ভূমিকম্প হয়, আর তা থেকে  তৈরি হয় এক ভয়ংকর সুনামির এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফুকুশিমা পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রও, সেদিন ওই সুনামি থেকে পনেরো হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। 

তাহলে চলুন দেখা যাকবাংলাদেশ বা ভারতের বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী যে অঞ্চলগুলো আছে তারা কতখানি ঝুঁকির মধ্যে আছে

জলোচ্ছ্বাসের সময় আমাদের উপকূলে ঢেউয়ের উচ্চতা অনেক বেশি হয় - আমরা ঘূর্ণিঝড়ের ভিডিওতে দেখেছিলাম যে আমাদের উপকূলের মহীসোপান বা continental shelf বেশ অগভীর এবং প্রায় ১০০ কিমি থেকে ২৫০ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত।  সুনামির ক্ষেত্রে কিন্তু এটা শাপেবর হয়েছে, কারণ, সুনামি মূলত তরঙ্গের গতির ওপর নির্ভরশীল। এই  তরঙ্গ মহীসোপানের স্বল্প গভীরতা থেকে ঘর্ষণের ফলে  অনেক শক্তি এবং গতি হারায়, ফলে আর তেমন ক্ষতিও করতে পারেনা।

ভূমিকম্পের তীব্রতা আর পানির উচ্চতা মেপে সুনামির অগ্রিম বিপদসংকেত জানানো যায়, কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। একটি ঘূর্ণিঝড়ের ১০০ মাইল অতিক্রম করতে এক দিনের বেশি লাগতে পারে, সেখানে একটা সুনামির লাগে মাত্র ১২ মিনিটসুনামির খবর আগে থেকে পেলেও উপকূলীয় এলাকা থেকে নিরাপদ এলাকায় সরে যাওয়ার সময় বা সুযোগ হয় না অনেক সময়। তাই সুনামির আশংকা আছে এসব জায়গায় ভূমিকম্প হলে উপকূল থেকে দূরে চলে যেতে হবে বা উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিতে হবে।

থিংকের ভিডিওতে আমরা দেখেছিলাম কোথায় ভূমিকম্প হবে, তার সাথে ফল্টলাইন বা টেকটোনিক পাতের  অবস্থানের একটা বিশাল ভূমিকা রয়েছে। ২০০৪ সালের সুমাত্রার সেই ভয়াবহ সুনামিটি ঘটেছিল   . মাত্রার  ভূমিকম্পের ফলে! ভূ-কম্পন বেশি অনুভূত হয়েছিলো ভূমিকম্পের কেন্দ্রের কাছাকাছি ফল্টলাইনে যা উত্তর-দক্ষিণ বরারর অবস্থিত, আবার এই ফল্টলাইনের চারপাশে পূর্বপশ্চিমেও কম্পন ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলে পূর্বপশ্চিমে  শ্রীলংকাসহ আরো অনেক দূরে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশকে আঘাত  হানলেও বাংলাদেশে আঘাত তেমন একটা টের পাওয়া যায় নি। কারণ আমরা সেই ফল্টলাইনের বাইরে এবং বেশি উত্তরে অবস্থিত এবং আমাদের বঙ্গোপসাগরের মহিসোপান অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত।

এদিকে আবার মায়ানমার উপকূলে ভারতীয় টেকটোনিক পাত বার্মিজ পাতের নিচে ঢুকেছে। এক পাতের নিচে আরেক পাতের ঢুকে যাওয়ার এলাকাকে বলা হয় সাবডাকশন জোন, এবং দুই পাতের ঘর্ষনের ফলে এই সাবডাকশন জোনে ভূমিকম্পের সম্ভাবন প্রবল থাকে।

ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশ মায়ানমারের উপকূলে কী প্রভাব পড়বে তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সিনারিওর সিমুলেশন করে দেখিয়েছেন যে সর্বোচ্চ .২৬১ মি উচ্চতার সুনামি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে মায়ানমারের পশ্চিম উপকূল বা রাখাইন কোস্টকে। তাই বাংলাদেশের উপকূলে শক্তিশালী ভূমিকম্প হলেও বাংলাদেশ এবং মায়ানমার উপকূল সুনামি থেকে তেমন ক্ষতিগ্রস্থ হবেনা।

বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি আছে, তবে বোঝা যাচ্ছে যে  সুনামির ভয়ে আতংকিত হওয়ার তেমন কোনও কারন নেই।

তবে আরো দক্ষিণে বা ফল্টলাইনের পশ্চিমে অবস্থিত ভারতের উপকূলীয় কিছু রাজ্য যেমন উড়িষ্যা, তামিলনাড়ু বা  অন্ধ্রপ্রদেশে এই  ঝুঁকি আরো বেশি। 

সুনামি থেকে অনেক বড় বড় বিপর্যয় ঘটে গেছে অতীতে। সুনামির ক্ষয়ক্ষতি সম্পূর্ণভাবে  এড়াতে না পারলেও  বিজ্ঞান প্রযুক্তির মাধ্যমে এখন আমরা অনেকখনি পূর্বাভাস পাচ্ছি এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারছি। আশার বিষয় যে সুনামি নিয়ে অনেক গবেষণা চলছে - সামনের দিনগুলোতে হয়তো আমরা সুনামির দানবকে পুরোপুরিই বোতল বন্দী করে ফেলতে পারবো।

সবচেয়ে বেশি দেখা ভিডিও দেখুন | Most Watched Video

?>

নিবন্ধসমূহ | Articles

সুনামি একটি জাপানি শব্দ, যার কাব্যিক পরিভাষা “বন্দরের উর্মিমালা বা ঢেউ।” সাগর কিংবা কোনও প্রকান্ড জলাধারে হঠাৎ কোনও দুর্যোগের ফলে যে ধারাবাহিক বিশালাকৃতির ঢেউ তৈরি হয় তাইই মূলত সুনামি