সূর্যের ঘূর্ণনে ব্রেক চেপেছে আইনস্টাইনের তত্ত্ব
সূর্যের ঘূর্ণন আইনস্টাইনের তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। সাধারণ আপেক্ষিকতা হল মহাকর্ষের তত্ত্ব যা আইনস্টাইনের দ্বারা 1907–1915 সালে বিকশিত হয়েছিল। সাধারণ আপেক্ষিকতার বিকাশ সমতা নীতি দিয়ে শুরু হয়েছিল, যার অধীনে তীব্র গতির রাজ্যগুলি এবং মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের বিশ্রামে থাকা (উদাহরণস্বরূপ, যখন পৃথিবীর পৃষ্ঠে দাঁড়িয়ে থাকে) শারীরিকভাবে অভিন্ন হয়।
সূর্যের সর্ববহিস্থ স্তরের ঘূর্ণনের গতি নিন্মমুখী এবং জোতির্বিদগণ মনে করেন এর জন্য আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বই দায়ী।
যদিও সুর্য আমাদের সবচেয়ে কাছের তারা, তবু এটি এখনো অনেক গূঢ় রহস্য লুকিয়ে রেখেছে। তবে দেখে শুনে মনে হচ্ছে সম্প্রতি সূর্য সম্পর্কিত একটি ধাঁধার সমাধান হয়েছে এবং এটি এমন একটি তত্ত্বের হাত ধরে হয়েছে যার শেকড় প্রোথিত হয়েছে ১৯০৫ সালে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের আলোকে।
বিশ বছর আগে সৌর জ্যোতির্বিদগণ উপলব্ধি করলেন সূর্যের সর্ববহিস্থঃ স্তরটি এর অভ্যন্তরীন অংশের চেয়ে ধীরে ঘূর্ণায়মান। বিষয়টি একটু অদ্ভুত। সূর্যের বিষুবীয় অঞ্চল এর মেরু অঞ্চলের চেয়ে দ্রুত ঘোরে-এটি ব্যাখ্যা যোগ্য। ডিফারেনশিয়াল ঘূর্ণন নামক এক প্রকার ঘূর্ণন দিয়ে এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু সূর্যের ধীর উপরিস্তরের ব্যাখ্যা পাওয়া দুষ্কর। দেখে মনে হয় কোনো একটি অদৃশ্য বল সূর্যের উপরের স্তরটিকে চেপে ধরে ঘূর্ণনে বাধা দিতে চাইছে।
তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিদ্যা ইনস্টিটিউট (IfA), ব্রাজিল এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী এই প্রশ্নের একটি উত্তরের সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়েছেন এবং এটি শেষ পর্যন্ত মৌলিক পদার্থবিদ্যার একটি বিষয়ের সামনে সূর্য়ের অদ্ভুতুড়ে ঘুর্ণনগতিকে দাঁড় করিয়ে দেয়। ধারণা করা হয় সূর্যের উৎপাদিত আলোক রশ্মি এর উপর ব্রেক চেপে ধরার কাজটি করছে।
এই প্রসঙ্গে IfA এর গবেষক, জেফ কান বলেন, “আমাদের সূর্যের ঘূর্ণন সহসাই থেকে যাবে না তবে আমরা দেখতে পেয়েছি সূর্য যে আলোর বিকিরণ তৈরি করে তা সূর্যে ‘ভাঙ্গন’ তৈরি করছে যার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের মাধ্যমে।”
আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব অনুমান করে, তড়িৎচৌম্বক বলবাহী ফোটন (যেমন: আলো) সামান্য পরিমান ভরবেগও বহন করে। যদি একটি বস্তু থেকে বিপুল পরিমান ফোটন নির্গত হয় তাহলে এই ক্ষুদ্র ভরবেগের পরিমানও আর ক্ষুদ্র থাকবে না; এরা বিপুল পরিমান ভরবেগবাহী হবে। সূর্য়ের চারশ’ কোটি বছর আয়ুস্কালে এর পৃষ্ঠ ফোটনের মাধ্যমে বিপুল পরিমান ভরবেগ হারিয়েছে যার কারণে সূর্যের উপরের দিকের ৫ শতাংশ পরিমান অংশের গতি ধীর হয়ে গেছে। পয়েন্টিং-রবার্টসন (Poynting-Robertson) প্রভাব নামে পরিচিত এই প্রক্রিয়া বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তু যেমন আন্তঃগ্রহ ধুলোবালি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইতিপূর্বে পরিলক্ষিত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় আমাদের সৌরজগতের গ্রহাণু বেল্টের গ্রহাণুগুলো মাঝে মাঝে টান অনুভব করে ভেতরের দিকে ছুটে আসে।
ধুলোবালির মধ্যে যে প্রভাব দেখা যায় তা সূর্যের উপরিভাগের গলিত তরলের মধ্যেও দেখা যাওয়ার কথা এবং এর আয়ুষ্কালে সূর্য হতে উৎপন্ন ফোটনের এই বাধা অদ্যাবধি যথেষ্ট পরিমাণ রহস্যময় প্রভাব তৈরি করেছে।
নাসা’র Solar Dynamic Observatory (SDO)-এর বেশ কয়েক বছরের সংগৃহীত তথ্য ব্যবহার করে গবেষকগণ সূর্যে প্রবাহিত তরঙ্গ পরিমাপ করতে পারেন এবং এ থেকে সূচারুভাবে বাধার সম্মুখীন হওয়া সূর্যের উপরিপৃষ্ঠের আবরণের পুরুত্ব নিরুপণ করতে পারেন। এই পদ্ধতিটির নাম helioseismology যা অনেকটা পৃথিবীতে ভূমিকম্পের তরঙ্গ পরিমাপ করে এর তীব্রতা নিরূপনের মতোই।
যদিও সূর্য কঠিন শিলায় তৈরি গ্রহ নয়, এর ঘন প্লাজমাজাতীয় অভ্যন্তরভাগ তরঙ্গ প্রবাহিত হতে সাহায্য করে যার ফলে এর পৃষ্ঠে স্পন্দন তৈরি হয় এবং এই স্পন্দন পৃথিবী হতে পরিমাপ করা যায়। এভাবে হেলিওসিসমোলজি প্রয়োগ করে গবেষকগণ আমাদের নিকটতম নক্ষত্রটির অভ্যন্তরীণ অনেক কিছু ‘দেখতে’ পান যা পৃষ্ঠে হয়তো তেমন দৃশ্যমান নয়। এই ক্ষেত্রে হেলিওসিসমোলজি প্রয়োগ করে আমরা হিসেব করতে পারি সূর্যের অভ্যন্তরভাগের তুলনায় বাহিরের স্তর কতটা ধীরে ঘুরছে, অর্থাৎ আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব সুর্যের বাহিরের স্তরটিকে কতটা চেপে ধরেছে।
এই প্রসঙ্গে জেফ কান বলেন, ‘ সূর্যের বাইরের আবরণটি খুবই মৃদু টর্কে ধীর হচ্ছে, তবে ৫০০ কোটি বছরের আয়ুষ্কালে এই সামান্য টর্কই বাইরের দিকে ৩৫ হাজার কিলোমিটার ব্যাপী উল্লেখযোগ্য প্রভাব তৈরি করেছে।’ তাঁর এই গবেষণার ফলাফল ইতিমধ্যে Journal of Physical Review Letter গবেষণাপত্রে ছাপার জন্য মনোনীত হয়েছে।
সূর্যকে অন্যান্য সকল নক্ষত্রের জন্য গবেষণাগার হিসেবে ব্যবহার করে কানের গবেষকদল বিশ্বাস করেন এই ধরনের প্রভাব অন্যান্য নক্ষত্রেও কার্যকর হয় এবং এটি নক্ষত্রের বিবর্তনে বিপুল ভুমিকা রাখে। এখন এই ধীর হয়ে যাওয়ার প্রভাব সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রে কতটা ভুমিকা রাখে সেই বিষয়ে সৌর জ্যোতির্বিদগণ কৌতুহলী। সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাব সমগ্র সৌরজগত জুড়েই রয়েছে। এই চৌম্বক ক্ষেত্রই সৌড় ঝড় ও উদগীরণ তৈরি করে যার প্রভাব পড়ে পৃথিবীর নানাবিদ বৈদ্যুতিক যন্তপাতি, কৃত্রিম উপগ্রহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে। এসব বিবেচনা করে বলা যায়, এই গবেষণাটি আমাদের পৃথিবীর উপর সূর্যের বিভিন্ন বিষয়ের প্রভাব আরো যথাযথ ভাবে উপলব্ধি করতে কাজে লাগবে।
-বিজ্ঞান পত্রিকা ডেস্ক