বিশ্বায়নের এই যুগে কোথায় না পৌঁছে গেছি আমরা- সুদূর অষ্ট্রেলিয়া থেকে আমেরিকা পর্যন্ত নিয়ে এসেছি আমাদের নিয়ন্ত্রনে - ব্যতিক্রম শুধু এন্টার্কটিকা! বরফের সাদা চাদরে ঢাকা বিস্তীর্ন রহস্যময় সেই মহাদেশ - এত্ত বড় যে আস্ত অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশকে পুরে ফেলা যায় এর ভেতরে - এখনো রয়ে গেছে আমাদের আওতার বাইরে!
কিন্তু বললে কী বিশ্বাস করবেন যে, আজকের এই প্রাণহীন বিশাল এন্টার্কটিকা একসময় ছিল আমাজন জঙ্গলের মত সবুজ, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা প্রাণবন্ত এক রেইনফরেস্ট?
সেই এন্টার্কটিকা কীভাবে রূপান্তরিত হয়ে গেল হিমবাহে ঢাকা সাদা এক মহাদেশে? যেখানে স্থায়ী জনবসতি তো দূরের কথা, গাছপালা, পশুপাখি কিছুরই তেমন দেখা মেলে না, শুধু পেঙ্গুইন বা সিল বাদে?
কোথায়, কীভাবে হারিয়ে গেল সেই প্রাণের সমারোহ?
আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি বছর আগে, প্রাকৃতিক জলবায়ু পরিবর্তনের হাত ধরে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা ভয়ানকভাবে বাড়তে শুরু করে। এই উষ্ণায়নের আসল কারণ পুরোপুরি জানা না গেলেও, আমরা জানি যে সে সময়ের গড় তাপমাত্রা ছিলো পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বোচ্চ - যদিও সেই উষ্ণায়নের হার ছিল আজ আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বাড়ার যে হার দেখছি তার চেয়ে অনেক কম! তবে সে আলোচনা আপাততঃ তোলা থাক আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের ভিডিওগুলোর জন্য।
এখন চলুন ফিরে যাই, সাড়ে পাঁচ কোটি বছর আগের সেই এন্টার্কটিকা মহাদেশে - সেই গরম সময়র গাল ভরা নাম হচ্ছে Paleocene-Eocene thermal maximum।
এন্টার্টিকাকে এখন পৃথিবীর এক্কেবারে দক্ষিণে যেরকম একা, সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন দেখি, সেরকম কিন্তু ছিলনা সেই সময়ে। থিংকের পাত সঞ্চালনের ভিডিওতে আমরা দেখেছিলাম কীভাবে অনবরত সরছে, ভাঙছে, গড়ছে মহাদেশগুলো। এন্টার্কটিকা তখন ছিলো অতি-মহাদেশ গন্ডোয়ানার অংশ - দক্ষিণ আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়া সাথে মিলে বিশাল এবং বিস্তীর্ণ এক বনাঞ্চল ছড়িয়ে ছিল সেখানে।
কীভাবে জানি?
আজকের বিশ্বে গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে যেসব গাছ ও ফুলের রেণু পাওয়া যায় তাদের ফসিল বহু পাওয়া গেছে এন্টার্কটিকার হিমবাহের নীচে - পাওয়া গেছে বিভিন্ন ধরেণের ডাইনোসর থেকে শুরু করে সরীসৃপ, দানবীয় সামুদ্রিক প্রাণীরও ফসিল। বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, সেসময় এন্টার্কটিকার গ্রীষ্মকালের গড় তাপমাত্রা ছিলো ১৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস, আর মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাতও হতো প্রচুর। ফলে, এন্টার্কটিকা জুড়ে গড়ে উঠেছিলো সবুজে ঘেরা বাস্তুতন্ত্র বা ecosystem।
তারপর?
তারপরে, এই এন্টার্কটিকা মহাদেশ অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার মাঝে বিস্তীর্ণ এক সেতু হিসেবে কাজ করতে করতে একসময় বিচ্ছিন্ন হয়ে হারিয়ে গেল সীমাহীন বরফের অতলে!
আর সেই কাহিনির ভিতরেই লুকিয়ে আছে জীবজগতের রোমাঞ্চকর আরেক ইতিহাস।
আজকে আমরা অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশে ক্যাঙ্গারু, কোয়ালা সহ বেশ কিছু প্রাণী দেখি যা পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যায় না। এই স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলো পেটের থলেতে বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, যাদেরকে বলে মারসুপিয়াল - এদের ভ্রূণ পূর্নাঙ্গ শিশুতে পরিণত হওয়ার আগেই গর্ভ থেকে বেরিয়ে মায়ের পেটের ঐ থলেতে মায়ের স্তনে মুখ দিয়ে আটকে থাকে যতদিন না বেরিয়ে আসার মত বড় নাআ হয়। অনেক মারসুপিয়ালই কিন্তু দেখতে অন্য মহাদেশের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মতই, তফাৎ শুধু পেটে বাচ্চার থলে। প্রকৃতির ইতিহাস খুঁড়লে দেখা যায় যে বেশিরভাগ মারসুপিয়ালের প্রাচীন পূর্বসুরীদের ফসিল পাওয়া যাচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকায়।
তাহলে তাদেরকে এখন শুধু অস্ট্রেলিয়ায় দেখা যায় কেন?
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে, শিকারীর আক্রমণ কিংবা খাদ্যের সংকটের কারণে হাজার হাজার বছর ধরে সেই বিপুলসংখ্যক প্রাণী দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ধীরে ধীরে পাড়ি জমাতে থাকে শত-সহস্র মাইল দূরে, পাশের মহাদেশ এন্টার্কটিকায়। পাত সঞ্চালনের ফলে ধীরে ধীরে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও এন্টার্কটিকা আরো কিছুকাল যুক্ত থাকে অষ্ট্রেলিয়ার সাথে। এ সময় আবার ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে পৃথিবীর তাপমাত্রা, পরিবর্তিত হতে থাকে জলবায়ু, এবং সে কারণে বিভিন্ন প্রাণী, ধীরে ধীরে মাইগ্রেট করতে শুরু করে পাশের দেশ - তখনও সংযুক্ত অষ্ট্রেলিয়ায়।
তারপরে একসময় - ক্রমাগতভাবে সরতে সরতে এন্টার্কটিকা, তিনটি মহাসমুদ্র দিয়ে বেষ্টিত হয়ে গিয়ে, সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পৃথিবীর বাকি স্থলভাগ থেকে ।
এন্টার্কটিকা , অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকা একসময়ে একই ধরণের উদ্ভিদ এবং প্রাণী ধারণ করলেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পরে কিন্তু তাদের মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই জৈব-বিবর্তন ঘটতে থাকে, যদিও তা ভিন্নভাবে, ভিন্ন গতিতে। ওদিকে আবার এন্টার্টিকার গড় তাপমাত্রা ক্রমশঃ আরো কমতে থাকে। ।
বাকি সব স্থলভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর কী ঘটল এন্টার্কটিকায়?
এর সাথে আবার যুক্ত হয় Antarctic circumpolar current (ACC) বা এন্টার্কটিকাক ঘূর্ণিস্রোত ।
এটাও কিন্তু আরেকটা মজার ব্যাপার।
এন্টার্কটিকা মহাদেশকে ঘিরে রাখা সমুদ্রগুলোর এই ACC হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিস্রোত। এখানে সেকেন্ডে প্রায় ১৪ কোটি ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়, যা সবচেয়ে বড় নদী আমাজনের পানির গড় প্রবাহের চেয়েও বহুগুণ বেশি। এই বিশাল ও তীব্র ঘূর্ণিস্রোত উষ্ণ পানিকে ঠেলে উত্তরদিকে সরিয়ে দেয় আর সমুদ্রের গভীর তলা থেকে শীতল পানিকে উপরে টেনে আনে। সারা পৃথিবী জুড়ে তাপমাত্রার পতন এবং এই ঘূর্ণিস্রোত - দুইয়ের প্রভাবে এন্টার্কটিকা আরো ঠান্ডা হতে থাকে।
পরবর্তী ২ কোটি ৫০ লক্ষ বছরে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রায় ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যায় - এন্টার্কটিকাক্রমশঃ ঢেকে যেতে শুরু করে বরফের পুরু চাদরে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় গাছপালা, পশুপাখি বিলুপ্ত হয়ে যায়, শুধু টিকে থাকে শীত সহ্য করতে পারা গাছপালা, পশুপাখি। ধীরে ধীরে তাপমাত্রা আরও কমতে থাকায় একসময় এগুলোও বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং আজ থেকে প্রায় ২৫ লক্ষ বছর আগে এন্টার্কটিকা পুরোপুরি হারায় জীবনধারণের উপযোগিতা।
এন্টার্কটিকায় প্রাণ বিলুপ্ত হয়ে গেলেও, আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশে, একই পূর্বসূরী থেকে উদ্ভব হওয়া বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রাণীরা বিবর্তনের নিয়মেই, পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য, অভিযোজিত হতে থাকে ভিন্ন ভিন্নভাবে। আমেরিকায় মারসুপিয়ালরা ধীরে ধীরে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়, আর অষ্ট্রেলিয়ায় আরো বিকশিত হয়ে বিবর্তিত হতে থাকে। এ কারণেই আমরা মারসুপিয়াল বলতে শুধু অস্ট্রেলিয়ার প্রাণী বলেই মনে করলেও কিছু মারসুপিয়াল প্রজাতি কিন্তু এখনো আমেরিকাতে আছে।
অন্যান্য মহাদেশের প্রানীদের সাথে তাদের মিল দেখলে বোঝা যায় যে তারা একই পূর্বসুরী থেকে বিবর্তিত হয়েছে। কী বিষ্ময়কর মিল অষ্ট্রেলিয়ান মারসুপিয়াল ইঁদুর, মারসুপিয়াল মোল, সুগার গ্লাইডার, মারসুপিয়াল খরগোশ, তাসমানিয়ান নেকড়ের সাথে সাধারণ ইঁদুর, মোল, আমেরিকান উড়ন্ত কাঠবিড়ালী, খরগোশ, নেকড়েদের মধ্যে! পার্থক্য একটাই, পেটের থলের বিবর্তন!
জলবায়ু পরিবর্তনের বদৌলতে সেই বরফে ঢাকা শীতল এন্টার্কটিকা আবার ক্রমশঃ গরম হয়ে উঠছে, লক্ষ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মত বরফের উপর দেখা মিলছে সবুজ শৈবালের - এ যেন সবুজীকরণ প্রক্রিয়ার শুরু আবার নতুন করে! বহুগুণ বেশি হারে গলছে লক্ষ লক্ষ বছরের পুরনো বরফশৈল ও হিমবাহ - এই হারে মেরুর বরফ গলতে থাকলে কয়েক দশকেই পৃথিবীর বহু উপকুলবর্তী নিমাঞ্চল ডুবে যাবে!
বাইশ শতকের পৃথিবীতেই হয়তো আবার এন্টার্কটিকা সবুজ হবে, কিন্তু এবারের, - মানে মানুষের তৈরি, এই ভয়ানক বৈশ্বিক উষ্ণায়নের রাশ টেনে ধরা না গেলে পৃথিবীর বাকী অংশকে কী মূল্য দিতে হবে কে জানে!